আল আমিন রনি:
পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন যে দুজন নেত্রী, তাদের একজন চিরবিদায় নিলেন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে আন্দোলনে আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি।
চার দশকের বেশি সময় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিন দফায় দশ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে করেছেন দেশ শাসন।
লেখক ও রাজনৈতিক ইতিহাসবেত্তা মহিউদ্দিন আহমদের মতে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে’। কিন্তু এরপর খুব বেশি সময় তিনি পাননি। তার স্ত্রী খালেদা জিয়াই বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন নিহত হলেন, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ।
সাংবাদিক শফিক রেহমান তার 'সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া' শীর্ষক লেখায় সেই সময়ের বর্ণনায় লিখেছেন: “খালেদা জিয়া তার দুই শিশু ছেলেসহ ছিলেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে তাদের বাসভবনে। আগে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এমনকি কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে তাকে বেশি দেখা যেত না।
“আগস্ট ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেও খালেদা লাজুক গৃহবধূরূপে তার দুই ছেলে তারেক রহমান (ডাকনাম পিনো) এবং আরাফাত (ডাকনাম কোকো)-কে নিয়ে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন।”
জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তখনকার উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসন হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভোরে সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর দলীয় রাজনীতিতে বিচারপতি সাত্তার প্রভাবহীন হয়ে পড়েন।
ওই সময় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিমুখী করতে বিএনপির মধ্যে চাপ তৈরি হয়। বিচারপতি সাত্তার রাজনীতি থেকে অবসর নিলে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। এরপর ১৯৮৪ সালের ১ মে তিনি হন দলের চেয়ারপারসন হন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির সঙ্গে থাকা খন্দকার মোশাররফ হোসেন এখন দলের স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গৃহবধূ থেকে ম্যাডামের রাজনীতিতে আসাটা ছিল বিএনপির রাজনীতির জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। দলের নেতৃত্বে এসে তিনিই বিএনপিকে একটি জনপ্রিয় দলে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।”
পরের বছরগুলোতে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের দুই নেত্রীর একজন, বিদেশি সংবাদমাধ্যমের ভাষায়, ‘দুই বেগমের’ একজন।
সমর্থকরা যেমন তাকে তার ‘আপসহীন দেশনেত্রী’ অভিধায় মনে রাখবে, ইতিহাসের পাঠে সমালোচনার কলামে তার ‘হাওয়া ভবন’ আর ‘জামায়াত-যোগের’ কথাও লেখা থাকবে।
আপসহীন নেত্রী’
আমৃত্যু দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া খালেদা জিয়া কীভাবে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে উঠলেন, সেই বিবরণও পাওয়া যায় শফিক রেহমানের লেখায়।
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ৯ বছর ধরে সেই আন্দোলনে এরশাদ সরকারের সঙ্গে কখনো আপস করেননি খালেদা।
অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তাই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার নাম হয় আপসহীন নেত্রী।
শফিক রেহমান লিখেছেন, “এরশাদ সরকার তখন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞামূলক আইন প্রয়োগ করে খালেদা জিয়ার গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখে। এতে খালেদা জিয়া দমে যান না। এরশাদ সরকার উৎখাত আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে যেতে থাকেন। অপর দিকে আওয়ামী লীগসহ অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় জেনারেল এরশাদ তার শাসনকে একটি বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক চেহারা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
“এরশাদ বিভিন্ন নির্বাচনের আয়োজন করেন। কিন্তু তার শাসনামলে সব নির্বাচন খালেদা বয়কট করেন। এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে খালেদা জিয়া তিনবার গ্রেপ্তার হন। এতে এরশাদের লাভ হয় না।”
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগও এরশাদ হঠাও আন্দোলনে যোগ দেয়। দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বহু প্রতীক্ষিত সংসদ নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট করেন খালেদা জিয়া। পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই বিজয়ী হন। আর বিএনপি এ নির্বাচনে বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
শৈশবের পুতুল
খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দর মজুমদারের আদি নিবাস ছিল ফেনী জেলার ফুলগাজী থানায়। ১৯১৯ সালে তিনি ফেনী থেকে জলপাইগুড়িতে যান। সেখানে বোনের বাসায় থেকে মেট্রিক পাস করেন এবং পরে চায়ের ব্যবসায় যুক্ত হন। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতেই বিয়ে করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ পর্যন্ত তারা সেখানেই ছিলেন।
বিএনপির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৬ সালের ১৫ অগাস্ট দিনাজপুর জেলায় খালেদা জিয়ার জন্ম। তবে তার জন্মদিন নিয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্ক বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়েছে। দেশভাগের আগে ওই সময়টায় জলপাইগুড়ি দিনাজপুরের মধ্যেই ছিল।
১৯৪৭ সালে খালেদা জিয়ার পরিবার বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেখানে মিশনারি স্কুলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরানোর পর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন খালেদা।
খালেদার পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি হন খালেদা জিয়া।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান ছিলেন ১ রম্বর সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য স্বাধীনতার পর তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। পরে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।
ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। ভাইবোনদের মধ্যে খুরশীদ জাহান হক এবং সাঈদ ইস্কান্দার মারা গেছেন। সেলিনা ইসলাম ও শামীম ইস্কান্দার এখনো জীবিত।
দলের নেতৃত্ব
জিয়া নিহত হওয়ার পর তার গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা-কর্মীরা অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় পড়ে। বিএনপির নেতৃত্ব আর ভবিষ্যত নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসে। দলের নেতারা তখন দ্বিধাগ্রস্ত, তাদের মধ্যে কোন্দলও প্রবল।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে ‘দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি’ হিসেবে পরিচিতি আর ৭৮ বছর বয়সের কারণে দলের ভেতরেও তার ওপর আস্থা ছিল না।
প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার 'চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা' বইয়ে লিখেছেন, সামরিক এবং শাসকচক্রের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিল খালেদা জিয়াকে নিয়ে। কারণ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য খালেদা জিয়াই সে সময় সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হতে পারতেন।
কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ চেয়েছিলেন সাত্তারই প্রেসিডেন্ট হোক। বিএনপির একটি অংশের সমর্থনে আব্দুস সাত্তারের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়।
খালেদা জিয়া তখন রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তার পরিবারও চায়নি তিনি রাজনীতিতে জড়ান। তবে দল টেকানোর জন্য বিএনপি নেতারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য 'আপস ফর্মুলা' হিসেবে খালেদা জিয়াকে বেছে নেওয়া হয়।
বিএনপির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য নেন খালেদা জিয়া। ওই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে যাত্রা শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হতে থাকেন।
দলের তরুণ একটি অংশ চাইছিল খালেদা জিয়াকে দলের নেতৃত্বে আনা হোক। অন্যদিকে প্রবীণ একটি অংশ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে বিএনপির প্রধান হিসেবে দেখেতে আগ্রহী ছিল। ফলে বিএনপির চেয়ারম্যান পদে একসঙ্গে প্রার্থী হন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার এবং খালেদা জিয়া।
বিএনপির ওয়েবসাইটে তখনকার ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, "এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারপতি সাত্তার দুবার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান। বেগম খালেদা জিয়া তাকে তরুণ নেতৃত্বের মনোভাবে কথা জানান। এসময় বিচারপতি সাত্তার বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ-সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান।
“কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে বিচারপতি সাত্তারের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।"
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করলে বিএনপির নেতত্বে নতুন সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠে। বার্ধক্য, অসুস্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে ধীরে ধীরে আড়ালে পড়ে যান সাত্তার। অন্যদিকে দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে।
এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৮৩ সালের মার্চে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। এ নিয়ে দলের ভেতরে দুই অংশের মতভিন্নতার মধ্যেই খালেদা জিয়াকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
দ্বিধা-বিভক্তির মধ্যে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে খালেদা জিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণটা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া যদি তখন বিএনপির হাল না ধরতেন তাহলে বিএনপি নিঃসন্দেহে গভীর সংকটে পতিত হত।”
ক্ষমতার চূড়ায়
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যে খালেদা জিয়া হয়ে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৯১-১৯৯৬ সাল এবং ২০০১-২০০৬ সাল দুই পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন খালেদা জিয়া। মাঝে ১৯৯৬ সালের ফব্রুয়ারিতে অধিকাংশ দলের বর্জনে এক তরফা নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করলেও সেই সরকারের মেয়াদ ছিল এক মাসেরও কম।
প্রবল গণ আন্দোলন ও বর্হিবিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। ওই বছর জুন মাসে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়া প্রথমবারের মত হন বিরোধী দলীয় নেতা।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে বিএনপি। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া ফের প্রধানমন্ত্রী হন।
আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর তুমুল আন্দোলনের মধ্যে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়। সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দয়িত্ব নেয় সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন পিছিয়ে যায়।
জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান। সংসদ ভবনের পাশে একটি ভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে রাখা হয় খালেদা জিয়াকে।
এক বছর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুত্তি পান তিনি। তারেকও মুক্তি পেয়ে লন্ডনে চলে যান, এখনো তিনি ফেরননি।
খালেদা জিয়ার মত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাও সে সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থার মধ্যে আলোচনায় ছিল দুই নেত্রীকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার ‘মাইনাস টু থিওরি’।
এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা চিকিসার জন্য বিদেশে গেলেও খালেদা জিয়া যেতে অস্বীকৃতি জানান।
তিনি সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এটাই আমার ঠিকানা। এদেশ এদেশের মাটি মানুষই আমার সব কিছু । কাজেই আমি দেশের বাইরে যাবো না।”
ওই সময়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য নেতা-কর্মী ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগালেও শেষ রক্ষা হয়নি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়। বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
সেই ভরাডুবির পর আর কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেনি খালেদা জিয়ার দল।
আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার কাছে খালেদা জিয়ার শাসনামল নিয়ে নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে দুর্নীতি তেমন একটা বিস্তার লাভ করেনি। ওই সময় তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
"বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীদেরকে ঘিরে যে কিছু প্রচলিত সংস্কার ছিল, সে সংস্কারের ব্যারিয়ারগুলো উনি ভেঙে ফেলেছেন। বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় উনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমার সবসময় মনে হয়।"
কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হবার পর প্রগতিশীল ধারা থেকে দলটি সরে আসে বলে মনে করেন ইফতেখার আহমেদ।
"উনাকে যেন ক্রমশই আপস করতে দেখা গেছে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং আপসের ফলে আন্তর্জাতিক যে মহল–প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য–এ দুই জায়গা থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।”
খালেদার ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ সে সময় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গেও একটি চুক্তি করে বাংলাদেশ, পরে যা আর এগোয়নি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই ধর্মীয় সংখ্যালঘু নীপিড়নের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়। খালেদা জিয়া যৌথবাহিনীকে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে অভিযান চালানোর অনুমতি দেন। সেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
পরের পাঁচ বছরে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় হাওয়া ভবন হয়ে ওঠে দুর্নীতির সমার্থক। জামায়াতের দুই নেতাকে সে সময় মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়, যারা পরে আওয়ামী লীগের আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দলটির নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়। সেই ঘটনার জন্য তখনকার বিএনপি সরকারকেই দায়ী করে আওয়ামী লীগ।
খালেদা জিয়ার জীবন কাহিনী নিয়ে বইয়ের লেখক সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ মনে করেন, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ক্যারিশমা দেখালেও কিছু ভুল করেছিলেন বিএনপি নেত্রী, যার খেসারত তাকে এবং তার দলকে দিতে হয়েছে।
২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে মাহফুজ উল্লাহ বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল তখন খালেদা জিয়ার উচিত ছিল সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেয়া। আর ২০০১-২০০৬ মেয়াদে খালেদা জিয়ার সরকারের কিছু দুর্বলতা ছিল।
“ওই সময়টিতে কিছু কিছু দুষ্টু লোক শাসন পদ্ধতিতে ঢুকে কিছু কিছু কাজকর্ম করেছে যেটার দায় গিয়ে তার ওপর পড়েছে। বিষয়টা তাই হয়। সে সময় যদি তিনি সরকারকে সুশাসনের পথে আরো আনতে পারতেন দৃঢ়তার সঙ্গে, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো ওইভাবে ঘটত না।"
রাজনীতির বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়টিও বিএনপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নিস্ফলা আন্দোলন, কারাবাস
চার দলীয় জোট সরকারের সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার দূরত্ব তৈরি হয়। টানাপড়েনের জেরে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয় একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে।
এক সময় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা অলি আহমদও দল ছেড়ে যান। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দলের মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াকে বহিষ্কার করে যান খালেদা জিয়া।
২০১০ সালে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে উৎখাত হন খালেদা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি সংসদের বাইরে চলে যায়, রাজপথই হয় দলটির ঠিকানা।
তবে বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষতা থেকে হঠাতে পারেনি খালেদা জিয়ার দল। ২০১৫ সালের শুরুতে টানা তিন মাসের হরতাল অবরোধে পেট্রোল বোমার আগুন সন্ত্রাসের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই বছরই খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু হয়, যা ছিল তার জন্য বড় ধাক্কা। সেই বৈরী সময়ে বড় ছেলে তারেকও দেশে ফিরতে পারেননি। দেশে একাকী সেই কঠিন সময় পাড়ি দিতেহয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে।
রাজনৈতিকভাবে সেই চাপের সময়ে খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় একের পর এক মামলা। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাতেও তার সাজার রায় হয়।
মহাবিপদে পড়া বিএনপি লন্ডনে থাকা তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়। খালেদা জিয়ার মুক্তি আর চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি বার বার প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে।
এর মধ্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে যায় বিএনপি। প্রশ্নদ্ধি সেই নির্বাচনে জয় মেলে মাত্র পাঁচ আসনে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ অনেকটা আকস্মিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। শর্ত অনুযায়ী তাকে থাকতে হয় গুলশানের বাসায়, বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও তার ছিল না।
ফলে মুক্তি পেয়েও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন একপ্রকার বন্দি জীবন কাটতে থাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের। এর মধ্যে কয়েকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
আর ফেরা হল না
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই বছর ৭ অগাস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। পরে উচ্চ আদালত তাকে দুই মামলা থেকেও খালাস দেয়। ফলে তার দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ার কলঙ্ক ঘোচে।
কিন্তু নানা ধরনের অসুস্থতা তাকে ততদিনে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে। মুক্তি মিললেও দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মূসচিতে তিনি আর সশরীরে অংশ নেননি।
এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। বহু বছর পর বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়।
দেশে ফেরার পর কিছু দিন ভালোই ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি প্রর্থী ঘোষণা করলে জানানো হয়, বগুড়া-৩, ফেনী-১ ও দিনাজপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন খালেদা জিয়া।
সবশেষ গত ২১ নভেম্বর ঢাকায় সেনা সদরের সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল খালেদা জিয়াকে। তার দুই দিনের মাথায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার কথা ভাবা হলেও স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
এরমধ্যে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান দীর্ঘ নির্বাসন ভেঙে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন। সেদিনই তিনি হাসপাতালে যান মাকে দেখতে।
সোমবার ছিল নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। বিএনপির অন্যান্য প্রার্থীদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার নামেও তিন আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। তার পরদিনই তার মৃত্যুর খবর আসে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “দেশনেত্রী আমাদের গণতন্ত্রের মাতা, আমাদের জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রাণের স্পন্দন। বেগম খালেদা জিয়া সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, অনেক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন, কারাবাস করেছেন। কিন্তু কখনোই গণতন্ত্রের অভিযাত্রা থেকে সরে যাননি, কখনো আপস করেননি।।
“এজন্যই দেশনেত্রীকে নিয়ে আমরা এত গর্ব করতে পারি। গণতন্ত্রীরা বুক টান করে কথা বলতে পারে।”
মনে রেখ ইতিহাস
রাজনীতির বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতির শীর্ষ আসনে উঠে আসা খালেদা জিয়া দেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে ‘গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের প্রতীকে’ পরিণত হয়েছিলেন।
“খালেদা জিয়ার মত এমন লড়াকু চরিত্র পুরো বাংলাদেশে শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিরল।”
মাহবুবুর রহমানের মূল্যায়নে, সরকারপ্রধানের দায়িত্বে ‘অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
“১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি যে ভ্যাট চালু করলেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তি দেওয়ার জন্য সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন, সেটাও তিনিই করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তিও তিনি দিয়েছেন।”
আর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর মূল্যায়ন, খালেদা জিয়া ‘ইতিহাসে তথ্য সৃষ্টি করেছেন’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৪৭ বছরের মধ্যে ৪১ বছর টানা চেয়ারম্যান পদে থেকে, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে এবং বেনজির ভুট্টোর পরে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়ে।
“তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছেন জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন উৎখাতে অবিচল আপসহীন থেকে এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যক্তিগত সৌজন্যমূলক আচার আচরণ ও মিতবাক হওয়ার কারণে।
“তিনি সচরাচর ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন না। আবার তার শাসনকালে আন্তর্জাতিক জরিপে বাংলাদেশের চার বার সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের অপবাদ পাওয়া, মেয়াদ শেষে নির্বাচনকালীন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য বিচাপতিদের মেয়াদে পরিবর্তন এনে দেশকে অস্থির করে তোলা, পুত্রের নিয়ন্ত্রণে ‘হাওয়া ভবনে’ সমান্তরাল শাসন চালিয়ে নজিরবিহীন দুর্নীতিকে প্রশ্রয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিজের একাধিক জন্মদিন পালন ইত্যাদি নেতিবাচক দৃষ্টান্তও লিপিবদ্ধ ও স্মৃতিবদ্ধ হয়ে থকেবে।”
খালেদা জিয়াকে নিয়ে শ্রদ্ধা আর তার সমালোচনার বাইরেও রয়েছে একটি গভীর সত্য।
তার জীবনগাথা অনেকটাই যেন বাংলাদেশের নিজের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, যে ইতিহাস অস্থিরতার বিপরীতে দৃঢ়তার বৈপরীত্যে ভরা, স্বীকৃতি ও আশার লড়াইয়ের উপাখ্যান।
কারও কাছে তিনি গণতন্ত্রের অবিচল প্রতীক। কারও চোখে তিনি এমন এক নেতা, যিনি পথ হারিয়েছিলেন।
তবে ইতিহাসের পাতায় তিনি সেই নারী হয়ে থাকবেন, যিনি দিনাজপুরের এক শান্ত ঘরোয়া জীবন থেকে উঠে এসে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন; আর সেখানে ছিলেন অনেকের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি সময়।
খালেদা জিয়া পেছনে রেখে গেলেন সেই দেশকে, যে দেশের জন্য তিনি লড়ে গেছেন।
তিনি রেখে গেলেন এক রাজনৈতিক দলকে, যে দলকে তিনি প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
আর রেখে গেলেন সাহস ও বৈপরীত্যে গড়া এক উত্তরাধিকার, যা নিয়ে বিতর্ক হবে, নতুন নতুন বয়ান তৈরি হবে, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা স্মরণ করবে।