‘নজরুল প্রতিভা’ হলো : চিরসবুজ, চিরনতুন, চিরজাগ্রত, চির-উন্নত শির। প্রেম-প্রাণ ও সুর সৃষ্টির জয়গাথায় নজরুল ‘বাঙালির বাংলা’ ধ্বনিতে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকল্প এঁকেছেন। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে যে দুখু মিঞা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর আর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সর্বত্র তাঁর স্মৃতি-সৃষ্টি ও কীর্তিগুণে হয়ে ওঠেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
আমাদের সংস্কৃতির পূর্ণতাদানে নজরুলের ঋণ অপরিশোধ্য। ভূগোল ও রাজনীতির বাইরে তাঁর অনুভব :
‘দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে
বেহুঁশ হয়ে চলেছি যেন কেঁদে কেঁদে কাবার পথে....।’
মানবপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে তিনি ধারণ করেন ‘বাঁশের বাসরী’ ও ‘রণতূর্জ’। তিনি সবার ও সারা বিশ্বের।
নজরুল মনন খুঁজে ফেরে জাতীয়, আত্মিক বিশ্লেষণ ও জাগরণী আহ্বান। কেননা ইসলামের মৌলিকত্ব তাঁকে বারবার ও বহুভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আল্লাহ নামের মহিমা ও প্রেম-তন্ময় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সার্থক উচ্চারণ ও চমৎকার নিবেদন :
নজরুল অনুভূতির সার্থক প্রকাশ হলো :
‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান...
যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া
জ্বীন পরী ইনসান.......।’
নজরুল হৃদয়ে নবীপ্রেম এক অনন্য উচ্চ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ বোঝাতে জাতীয় কবির উচ্চারণ—
‘ওরে ও দরিয়ার মাঝি, মোরে নিয়ে যারে মদীনায়
তুমি মুরশিদ হয়ে পথ দেখাও ভাই, আমি যে পথ চিনি না।’
বলা বাহুল্য, প্রেম ও দ্রোহের সম্মিলনে নজরুলকে যত সহজ মনে হয়, নজরুল তত সহজ ও সাধারণ নন।
তাঁর সৃষ্টি নানান ধারা ও বিচিত্ররূপে বিস্ময়কর এবং খানিকটা জটিল। মাত্র বাইশ-তেইশ বছরের সাহিত্য সৃষ্টির অনন্যতায় তিনি ‘রাবীন্দ্রিক বলয়’ ভেঙে প্রতিভার দ্যুতিতে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ দিয়েছেন নতুন পথের সন্ধান। আজানের মধ্যেও কাজী নজরুল শুনেন অসাধারণ সুধাময় সুর মূর্ছনা :
‘দূর আজানের মধুর ধ্বনি বাজে বাজে মসজিদেরই মিনারে।
এ কী খুশির অধীর তরঙ্গ উঠলো জেগে প্রাণের কিনারে।’
হাদিসের বিবরণে পাওয়া যায় যত দূর আজানের শব্দ পৌঁছে ততটুকু এলাকা ছেড়ে শয়তান দৌড়ে পালায়। তাই কাজী নজরুল আজানের মধ্যে মানসিক প্রশান্তির ঠিকানা আবিষ্কার করেছেন :
নজরুলের বিবেচনায় আজানের শক্তি মানুষকে পৌঁছে দেয় এক অনন্য উচ্চতায় :
‘ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর
তখনো জাগিনি যখন যোহর
হেলায় ফেলায় কেটেছে আসর
মাগরেবের ঐ শুনি আজান...।’
নজরুলের গানগুলোর শ্রেণিবিন্যাসে দেখা যায় মৌলিকত্বের বিচারে তা ৪৯ রকমের বা আরো ভিন্ন মাত্রিক। ভজন, কীর্তন, ভক্তিমূলক, ভাটিয়ালি, কাওয়ালি, গজল, এমনকি ফসল কাটা ও ছাদ পেটানো গানেও নজরুলকে খুঁজে পাওয়া যায়। শব্দ চয়নে তিনি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিদ্ধহস্ত। বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলামের কৃতিত্ব আরবি, ফারসি, হিন্দিসহ নানান শব্দের সার্থক রূপায়ণ। সুরের ক্ষেত্রে ইরানি ও আরব মরুময়তার ঝঙ্কার এবং তুরস্ক, খোরাসান, তাসখন্দ, আফগানি আবার আদি ভারতীয় সুরের সঙ্গে উপজাতীয় ধারার সার্থক সমন্বয়ের প্রতিফলন লক্ষণীয় একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিসম্ভারে। খাম্বাজ, কাহারবা, ভৈরবী- কোনো সুর-তালই তিনি বাদ দেননি।
পরিশেষে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও পাঠকের বিরক্তি চরমে পৌঁছার আগেই হৃদয়গ্রাহী অনুরণনে লেখাটির পরিসমাপ্তি ঘটানো শ্রেয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অন্তিম আকাঙ্ক্ষার সার্থক বাস্তবায়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তাঁর সমাধি সৌধ। কেননা তাঁর আবেগঘন আকুতি :