আয়কর আদায়ে সরকার পুরোনো পথেই কেন হাঁটছে?

অনলাইন ডেস্ক:-
একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে দেখা যায়—মাটির চাপ যতই বাড়ুক না কেন, একটি নির্দিষ্ট পণ্য ১,২৫০ ফুট গভীরেও সেই চাপ নিতে সক্ষম। আমাদের দেশের করনীতি যেন সেই বিজ্ঞাপনের অনুকরণে চলছে। করদাতাদের প্রতি এমন মনোভাব গড়ে উঠেছে যে, তারা যেকোনো চাপ সহ্য করতে বাধ্য। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীরা—যাদের বেতন থেকেই আগেই কর কেটে রাখা হয়। এ যেন কর আদায়ের সবচেয়ে সহজ পথ। কর বাড়াতে হলে, করের হার বাড়িয়ে দাও—এই যেন সহজ সমাধান। এতে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেল কি না, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা নেই।
প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার সময় করদাতারা আশায় বুক বাঁধেন, এই বুঝি কিছুটা করের বোঝা কমবে। বাস্তবতা হলো, তাদের সেই আশার গুড়ে বরাবরই জল ঢেলে দেয় সরকার। বছর ঘুরলেই আসে করবৃদ্ধির নতুন খড়্গ।
পূর্ববর্তী সরকার জনবিচ্ছিন্ন ছিল বলে অনেকেই আশা করেছিলেন, নতুন সরকারের কাছে হয়তো করনীতি হবে আরও মানবিক ও যুক্তিসম্মত। বিশেষ করে বর্তমান সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ এবং উপদেষ্টা পরিষদেও রয়েছেন অনেক গুণীজন। তাই ধারণা করা হয়েছিল, এবার বুঝি করদাতাদের জন্য কিছু সহনীয় সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এবারের বাজেটেও সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
বরং আবারও সেই পুরোনো কৌশল—যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপরই চাপ বাড়ানো হয়েছে। করের ধাপ ও হার বাড়িয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ২০২৫-২৬ করবর্ষে অনেক করদাতার করের পরিমাণ বেড়েছে গড়ে ৯ শতাংশ হারে। আর ২০২৬-২৭ করবর্ষে কারও মাসিক আয় যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে তার বার্ষিক কর বেড়ে যাবে ১২.৫ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ, কার্যত আপনার আয় না বাড়লেও করের চাপে বেতন কমে গেল।
এই করবৃদ্ধির দুঃসংবাদ এল এমন এক সময়ে, যখন দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় আগেই কমে গেছে। এর মানে, মধ্যবিত্ত বা চাকরিজীবী মানুষ এখন দ্বিগুণ সংকটে পড়েছে—একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে কর বৃদ্ধি।
বাজেটে বলা হয়েছে, কর রেয়াত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে করহার বৃদ্ধির কারণে রেয়াতের যে সামান্য সুবিধা, তা কয়েকগুণ কর আদায়ের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এটি নিছক শুভঙ্করের ফাঁকি নয়, বরং একধরনের বৈষম্যপূর্ণ আচরণ।
এইভাবে কর বাড়িয়ে সরকার খুব বেশি রাজস্ব পায় না। বরং এতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ আয়কর রিটার্ন জমা পড়ে, তার একটি বড় অংশ কর আদায় পর্যন্ত গড়ায় না। কর কাঠামোর এই বৈষম্য এবং অসংগতি দূর না করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব হলো—কর আদায় বাড়াতে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে, করের হার নয়। করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করতে হবে। একই সঙ্গে করহারকে সহনীয় ও স্তরভিত্তিক করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রস্তাব করা যেতে পারে—
-
৫ লাখ পর্যন্ত: করমুক্ত
-
পরবর্তী ১ লাখ পর্যন্ত: ৫%
-
পরবর্তী ৪ লাখ: ১০%
-
পরবর্তী ৫ লাখ: ১৫%
-
পরবর্তী ৬ লাখ: ২০%
-
পরবর্তী ৩০ লাখ: ২৫%
-
এরপর: ৩০%
এছাড়া, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের জন্য করের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে পেনশন হিসাবে জমা রেখে আজীবন পেনশন সুবিধা চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি করদাতাদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা (হেলথ ইনস্যুরেন্স) সুবিধাও যুক্ত করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিতে আগ্রহী হবেন।
সহনীয় করনীতি, সুনির্দিষ্ট প্রতিদান এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে কর আদায়—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করলেই করব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার-অর্থনীতি বিশ্লেষক।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫