ঢাকা প্রেস নিউজ
দেশের ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ হঠাৎ করে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকে গত ১০ মার্চ পর্যন্ত সরকার নিট ৩৮ হাজার ৫১০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। যেখানে গত জানুয়ারি পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রথম সাত মাসে নেওয়া ঋণের তুলনায় শেষ এক মাস দশ দিনে ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তবে এখনও পর্যন্ত নেওয়া ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ লক্ষ্য কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থার বাস্তবতায় ঋণ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখা হবে।
বর্তমান সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করলেও ঋণের সুদ পরিশোধ ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা কম। অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণের পরিমাণ ঋণাত্মক হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, তার চেয়ে ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। বিদেশি উৎস থেকেও ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে। ফলে সরকার ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। একই সময়ে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ৪৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিশোধ করায় মুদ্রা সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য ২৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা নতুন মুদ্রা সরবরাহ করেছে, যা অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করেছে।
গত সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বিপুল পরিমাণ ঋণ আত্মসাৎ করায় বর্তমানে অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ছে। এর ফলে, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন দফায় বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
১০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা, যা গত জুন শেষে ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৪ লাখ ৪ হাজার ১০৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গত জুন শেষে ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ১ লাখ ৮ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নেমেছে, যা গত জুন শেষে ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা।
সঞ্চয় প্রবণতা কমে যাওয়ার ফলে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৭.৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের দায় শোধ করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে, যা ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে। গভর্নর আশা প্রকাশ করেছেন যে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে।
সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ প্রবাহ ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো না গেলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে।