আমদানি খরচ কমলেও বিদেশি সেবা ও পরিবহন খরচ এবং ঋণ পরিশোধে যে খরচ হচ্ছে, তাতে ডলারের আয়-ব্যয়ে বড় অঙ্কের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করার পর এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আসছে, তার চেয়ে আমদানি খরচ কম। তারপরও বিদেশি সেবা ও পরিবহন খরচ এবং বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে যে খরচ হচ্ছে, তাতে প্রতি মাসে ডলারের আয়-ব্যয়ে বড় অঙ্কের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আবার সময়মতো রপ্তানি আয় দেশে আসছে না, এতেও ডলারের সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
এদিকে রপ্তানি আয় সময়মতো না আসায় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে পোশাক খাতের অনেক উদ্যোক্তাকে ডলার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ইডিএফের ৭০০ কোটি ডলার বা ৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল নেমে এসেছে ৪৪৯ কোটি ডলার বা ৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে। ফলে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। আর অন্য খাতের উদ্যোক্তাদের ১১৩ টাকা পর্যন্ত দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা সংকট এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কেন কমছে না। গত বছরের জুলাইয়ে যোগ দিয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, জানুয়ারিতেই ডলার-সংকট কেটে যাবে; কিন্তু তা হয়নি। তাই সংকট কাটতে এখন আর কোনো সময়সীমার কথা বলছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণপত্র খুলতে না পারায় দিন দিন ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়ছে। পোশাকের অনেক ক্রেতাও প্রতারণা করছে, সময়মতো বিল পাঠাচ্ছে না। এর কারণে নতুন করে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ইডিএফ সুবিধা মিলছে না। ফলে সুবিধাগুলো দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সামনের ঈদে অনেক কারখানা বেতন-বোনাস দিতে পারবে না। এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কেন সংকট কাটছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
ডলারের আয়-ব্যয় মিলছে না
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। আর গত জুলাই-এপ্রিলে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৬ হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। গত এপ্রিলে আমদানি কমেছে ৩২ শতাংশ।
গত এপ্রিলে আমদানি খরচ হয় ৫২২ কোটি ডলার। ওই মাসে রপ্তানি হয় ৪৮৪ কোটি ডলার ও প্রবাসী আয় আসে ১৬৮ কোটি ডলার। ফলে আয়ের চেয়ে খরচ কম হচ্ছে। তবে বিদেশে স্বাস্থ্য, সেবা, বিদেশি জাহাজ ও বিমানভাড়া, ভ্রমণ, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ডলার খরচ হচ্ছে। গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে এসব সেবায় ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩২৩ কোটি ডলার। এ ছাড়া রয়েছে বিদেশি ঋণ পরিশোধ। ফলে ডলারের ওপর চাপ কোনোভাবেই কমছে না। সামনে বিদেশি ঋণ পরিশোধের বড় সূচি আসবে, আয় না বাড়লে চাপ তখন আরও বাড়বে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৪ কোটি ডলার বা ৯৬.২৪ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ২ হাজার ৯৭৭ কোটি ডলার। এখন ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, রপ্তানি আয়ে ১০৭ টাকা ও আমদানিতে ডলারের দাম দিচ্ছে ১০৮-১০৯ টাকা। আর রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০৬ টাকা দামে ডলার বিক্রি করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্ত মেনে রিজার্ভ ধরে রাখতে পারছে না। কারণ, জরুরি আমদানি দায় মেটাতে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
সংকট কাটবে কবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি সব বড় প্রকল্পে ডলার খরচ হয়েছে। ডলারে ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প করা হয়েছে, যেখানে ডলার আয় হচ্ছে না। একই অবস্থা বেসরকারি খাতেও। এই কারণে চাপ সহজে যাবে না।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত রাতে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না থামলে ডলার-সংকট কাটবে না। প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি এই বুঝি যুদ্ধ থেমে গেল, কিন্তু থামছে না। এই কারণে আমেরিকায় একের পর এক ব্যাংকে ধস নামছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গত বছরের জুনের তুলনায় গত এপ্রিলে ডলারের বিপরীতে টাকা মান হারিয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপি মান হারিয়েছে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।’ এর ফলে গত মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
বেসরকারি দুটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে প্রবাসী আয় আসা ও রপ্তানি আয় আসা বাড়বে। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। এ ছাড়া পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।