প্রকাশকালঃ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:০২ অপরাহ্ণ ২৪৭ বার পঠিত
সম্পত্তি বা কোনো বস্তু ওয়াকফ করার পর যাতে ওয়াকফের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়, সম্পত্তি সংরক্ষিত থাকে, কোনো ধরনের খিয়ানত না হয় এবং যথেচ্ছা খরচ না হয়, সে জন্য একজন বিশ্বস্ত আমানতদার, বুদ্ধিমান, ধার্মিক ব্যক্তিকে এ ওয়াকফ সম্পত্তির অভিভাবক নিয়োগ করা প্রয়োজন। এমন ব্যক্তিকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘মুতাওয়াল্লি’ বলা হয়। মুতাওয়াল্লি নিয়োগের অধিকার ওয়াকফকারীর নিজের। তাঁর মৃত্যুর পর এ অধিকার লাভ করবে তাঁর নিয়োগকৃত অসি (অসিয়ত বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তারপর এ দায়িত্ব বর্তাবে সরকার বা সরকারি প্রতিনিধির ওপর। (ফতোয়া শামি : ৪র্থ খণ্ড)
ওয়াকফকারী ইচ্ছা করলে মুতাওয়াল্লির পদটি নিজের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেন এবং তিনি নিজে মুতাওয়াল্লি হতে পারেন। আর তিনি ইচ্ছা করলে এ শর্তও আরোপ করতে পারবেন যে তাঁর বংশধরদের থেকে কাউকে মুতাওয়াল্লি নিয়োগ করা হবে। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
ওয়াকফকারী ব্যক্তি তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত মুতাওয়াল্লি থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান বা আদালত তাঁকে এ দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে পারবে না। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
প্রাপ্তবয়স্ক, জ্ঞানবান, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি যে স্বয়ং নিজের অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম তাঁকে ওয়াকফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লি নিয়োগ করা বৈধ। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ এবং চক্ষুষ্মান ও অন্ধের কোনো প্রভেদ নেই। আর যে ব্যক্তি পাপাচারী নয় এবং যার মধ্যে পদলোভ নেই, এমন ব্যক্তিকে এ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া উত্তম।
আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর দুজন সঙ্গী যখন রাসুল (সা.)-এর কাছে প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করে, তখন তিনি তাদের বলেন, আমরা আমাদের কাজে এমন কাউকে নিযুক্ত করি না, যে পদ চেয়ে নেয়। এবং এমন ব্যক্তিকেও নয়, যে পদের লোভ করে বা তার প্রত্যাশা করে। (বুখারি, হাদিস : ৭১৪৯)
উল্লেখ্য, মুতাওয়াল্লি হওয়ার জন্য মুসলমান হওয়াও জরুরি নয়। আর ওয়াকফ করার সময় মুতাওয়াল্লি কে হবেন, তা যদি উল্লেখ না করা হয়ে থাকে, তাহলেও ওয়াকফকারী এ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লি নির্ধারিত হবেন। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
যদি কোনো ব্যক্তি কয়েকটি জমি ওয়াকফ করে এবং প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথক মুতাওয়াল্লি নিয়োগ করে তাহলে তা-ও জায়েজ আছে। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপারে ওয়াকফকারী যদি বলে, আমার মৃত্যুর পর অমুক ব্যক্তি মুতাওয়াল্লি হবে। তারপর অমুক ব্যক্তি। তারপর অমুক ব্যক্তি, অর্থাৎ পরম্পরা যদি স্থির করে দেয়, তাহলে ওয়াকফকারীর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে তারা মুতাওয়াল্লি নিয়োজিত হবে। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
মুতাওয়াল্লি ইচ্ছা করলে তার কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান কার্য সম্পাদন করতে পারবে। তবে নিয়োগ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি মুতাওয়াল্লির এখতিয়ারাধীন থাকবে। নাবালিগ ব্যক্তিকে মুতাওয়াল্লি নিয়োগ দেওয়া হলে বালিগ হওয়া পর্যন্ত তা স্থগিত থাকবে। বালিগ হওয়ার পর সে মুতাওয়াল্লি সাব্যস্ত হবে। (ফতোয়া শামি, ষষ্ঠ খণ্ড)
ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন
বর্তমানে মসজিদ-মাদরাসা ও অন্যান্য ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার জন্য পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে। এ কমিটি মূলত মুতাওয়াল্লির সহযোগী এবং তাঁর প্রতিনিধি। তাঁদের নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়টি মুতাওয়াল্লির পূর্ণ এখতিয়ারাধীন। কাজেই যদি উক্ত কমিটি ওয়াকফ সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয় বা তাদের পক্ষ থেকে যদি কোনো ধরনের খিয়ানত, বিশৃঙ্খলা, আত্মসাত্মূলক কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কাজ সংঘটিত হয়, মুতাওয়াল্লি এ কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করবে। তবে বিনা কারণে কমিটি বাতিল করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা সমীচীন নয়। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন হতে পারে যে ওয়াকফকারী একাধিক ব্যক্তিকে (ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান) মুতাওয়াল্লি নিয়োগ করে তাদের ওপর পরিচালনার ভার অর্পণ করেছে এবং তারাই পরিচালনা কমিটিরূপে পরিচিত—সে ক্ষেত্রে ওই কমিটি স্বয়ং মুতাওয়াল্লির সমপর্যায়ের ক্ষমতা রাখে। (ফতোয়া শামি, চতুর্থ খণ্ড, আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
মুতাওয়াল্লি কর্তৃক নিয়োগকৃত পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব
ওয়াকফ সম্পত্তি যথাযথ সংরক্ষণ এবং এর আয়-উৎপাদন যথাযথ খাতে ব্যবহার করাই মুতাওয়াল্লি ও পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব। ওয়াকফের আয় দ্বারা সর্বপ্রথম নির্মাণ ও সংস্কার জাতীয় কাজ সম্পাদন করা হবে। যদি সমুদয় আয় এ কাজে ব্যয় হয়ে যায়, তবু এটা করা মুতাওয়াল্লি ও পরিচালনা কমিটির প্রথম দায়িত্ব। যেমন—মসজিদ জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে বা ঈদগাহ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে গেলে ফান্ডের অর্থ দ্বারা সর্বপ্রথম নির্মাণ ও সংস্কারকাজ সম্পাদন করতে হবে। তারপর আয়ের কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকলে নির্মাণ ও সংস্কারকার্যে এবং কাছাকাছি যে কাজ আছে, তাতে সে অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর তা হচ্ছে ওয়াকফের অভ্যন্তরীণ বিনির্মাণ—যদ্দ্বারা ওয়াকফের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। যেমন—মসজিদের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্টাফ, মাদরাসার শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রধান করা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে তাদের এ পরিমাণ বেতন-ভাতা দিতে হবে, যা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট হয়। এবং তা প্রতিষ্ঠানের আয়, ওই সমাজের মানুষের জীবন-মান ও দেশের সার্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর পরও কিছু বেঁচে থাকলে তা ওয়াকফের অন্যান্য প্রয়োজনে যেমন—বিছানা, মোমবাতি, কার্পেট, ছাউনি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করা হবে। (ফতোয়া আলমগিরি, দ্বিতীয় খণ্ড)
ওয়াকফ সম্পত্তির প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার পর যদি কিছু টাকা পয়সা বেঁচে যায়, তাহলে মুতাওয়াল্লি বা পরিচালনা কমিটি লাভজনক কোনো কাজে তা বিনিয়োগ করতে পারবে। যেমন—বাড়িঘর কিনে রাখতে পারে। ক্রয়কৃত এ বাড়িঘর মূল ওয়াকফ সম্পত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তা ওয়াকফ সম্পক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে না। কাজেই এই সম্পত্তি (বেশি দাম পাওয়ার আশায় বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে) বিক্রি করা জায়েজ হবে। তবে এর বিক্রিলব্ধ অর্থ ওয়াকফের কাজে ব্যয় করতে হবে। (ফতোয়া শামি, চতুর্থ খণ্ড)