আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে এ প্লাস নিয়ে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন এ প্লাস) পেয়েছে গন্ধা রানি বিশ্বাস রিমা ও রাখি রানি। কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা থেকে তারা ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় এই কৃতিত্ব অর্জন করে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে এই দুই কিশোরীর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রিমা ও রাখির বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের যতিনের হাট গ্রামে। তারা সম্পর্কে চাচাতো বোন, আবার সহপাঠী। রিমার বাবার নাম কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাস ও মায়ের নাম রিতা রানি বিশ্বাস। বাবা ১২ বছর আগে মারা গেছেন। বড় বোন বগুড়ায় নার্সিংয়ে পড়াশোনা করছেন। রিমার মা দিনমজুরের কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালান। অনটনের সংসারে দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
রাখির বাবার নাম রাখাল চন্দ্র, মায়ের নাম চারুবালা দাস। ছোট পানের দোকানি রাখাল চন্দ্রের তিন মেয়ের মধ্যে রাখি বড়। পান বিক্রির টাকায় কোনোমতে সংসার চললেও মেয়েদের লেখাপড়ার ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলে দাবি এই দম্পতির।
রিমার মা রিতা রানি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েদের নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছি। আমারও বাবা-মা বেঁচে নেই। সংসারে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। বিসিক শিল্প নগরীতে একটি তুলা কারখানায় কাজ করতাম। দেড় বছর আগে আগুনে পুড়ে যাওয়ায় সেটিও বন্ধ। এখন মাঝে মাঝে দিনমজুরের কাজ করি। যা পাই তা দিয়ে সংসারের খরচ মেটে না। বড় মেয়ে নার্সিংয়ে পড়ে। তাকে প্রতি মাসে খরচ দিতে হয়। এখন ছোট মেয়ে এসএসসি পাস করছে। ভালো রেজাল্ট করছে কিন্ত কলেজে ভর্তি আর বইপত্র কিনে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য আমার নাই।’
আর্থিক টানাপড়েনে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হতে পারে জানিয়ে রিতা বলেন, ‘মেয়ের পড়ার অনেক ইচ্ছা। কিন্তু টাকা না পেলে কীভাবে পড়াবো। আমি মেয়ে মানুষ, এত টাকা কীভাবে জোগাড় করবো? না পারলে মেয়েকে পড়াতে পারবো না।’
অনটন রাখির বাবার সংসারেও। ছোট পানের দোকানের আয় দিয়ে তিনিও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলে জানান রাখির মা চারুবালা। তিনি বলেন, ‘রাখিকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াতে কাহিল হয়েছি। প্রাইভেট কোচিংয়ে দিতে পারিনি। ওর বাবার আয় দিয়ে এত খরচ মেটে না।’
‘গ্রামের এক শিক্ষকের কাছে রিমা ও রাখি সব বিষয়ে পড়েছে। এখন পড়াতে গেলে কলেজে যাওয়া আসা, কয়েকটা বিষয়ে প্রাইভেট পড়া- এতো খরচ জোগাতে পারবো না। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। না পারলে বাড়িতে বসিয়ে রাখতে হবে,’ যোগ করেন চারুবালা।
রিমা ও রাখি জানায়, তাদের ইচ্ছা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। তারা আরও পড়তে চায়। রিমার স্বপ্ন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়বে। আর রাখির ইচ্ছা সে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হবে। কিন্তু এই দুই বোনের স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারের অভাব, অভিভাবকদের অর্থ সংকট।
রিমা বলে, ‘মা একা আর খরচ জোগাতে পারছেন না। আমি চাই, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। চাকরি করে মায়ের কষ্ট লাঘব করবো। কিন্তু আমার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা সেই সংশয়ে পড়ে গেছি। সরকার কিংবা কোনও সংস্থা থেকে শিক্ষা বৃত্তি পেলে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হতো। অন্তত পড়াশোনাটা শেষ করতে পারতাম।’
রাখির মন্তব্য একই। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা এই কিশোরী বলে, ‘ছোট দোকান করে বাবা হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক সময় আমি নিজে গিয়ে বাবার দোকানে বসি, বাবা মালামাল কিনতে যান। বাবাকে চাপ দিয়েও লাভ নাই। আমাদের পড়াশোনার জন্য কেউ সহায়তা করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।’
যতিনের হাট গ্রামের বাসিন্দা ও রিমা-রাখির প্রাইভেট শিক্ষক সুজন সরকার বলেন, ‘ওরা দুই বোন অনেক মেধাবী। পড়াশোনার প্রতি ওদের অনেক আগ্রহ। এ জন্য অভাবের মধ্যেও অনেকের চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে এখন ওদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকার, কোনও সংস্থা কিংবা বিত্তবান কেউ এগিয়ে এলে ওরা উপকৃত হতো। পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারতো।’