ঢাকা প্রেস
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে তিস্তার চরাঞ্চলে বর্তমানে আলু চাষে কৃষকেরা ব্যস্ত সময়ে পার করছেন। আলু চাষে লাভবান হওয়ার কারণে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ার আশায় চরাঞ্চলের কৃষকরা এই কাজে ঝুঁকে পড়েছেন। ফলস্বরূপ, চরের মাঠে আলু চাষের কাজ চলার ফলে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা আলু চাষে নিয়োজিত রয়েছে, যেখানে প্রধানত নারী শ্রমিকেরা আলু রোপণের দায়িত্বে থাকে এবং তাদের বিশ্রামের সময় নেই।
উপজেলাভুক্ত তিস্তা নদীর তীরবর্তী থেতরাই ও বজরা ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চলে ব্রি-৭১, ব্রি-৭৫, ব্রি-৮৭ ও বীনা-৭ জাতের ধানসহ স্বল্পমেয়াদী আগাম জাতের আমন ধান রোপণ করা হয়েছিল। বর্তমানে ধান কাটা ও মাড়াই প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই জমিগুলোকে আলু চাষের জন্য উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। আলু চাষের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ১টি পৌরসভা সহ ১৩টি ইউনিয়নে আলু চাষের লক্ষ্য মাত্রা প্রায় ৭২০ হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১,৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে ৯৬৫ হেক্টর জমিতে এই কাজ চলছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬,৩০০.৭৫ মেট্রিক টন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আলু চাষিদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেয়া অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিন উপজেলার তিস্তার চর বেষ্টিত গোড়াইপিয়ার চর, আম্নিয়াসের চর, জুয়ান সতরার চর, দরিকিশোরপুর চর, টিপমা চর, শুকদেবকুন্ড চর, বজরা চর, সাতালস্কারের চর সহ আরও অনেক এলাকায় আলু চাষ ও নিড়ানিতে ব্যস্ত কৃষকরা সময় পার করছেন। তারা আগাম আলু চাষ করে ভালো দামে বাজারে বিক্রি করার আশায় নিয়োজিত, যাতে করে আলু চাষের পর শরিষা, গম, পিয়াজ সহ বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ করতে পারেন।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, চলতি বছরে দু’দফায় বন্যার কারণে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা আগাম আলু চাষের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে, আলুর বীজ, সার ও কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আলু চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। তবুও, আলুর বাজার দর তুলনামূলক বেশি থাকায় কৃষকেরা আগাম জাতের আলু চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াইপিয়ার চর থেকে আলু চাষি নুর ইসলাম (৪২) জানিয়েছেন, তিনি এবারে ১০ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন, যার মধ্যে ২ একর জমিতে আগাম জাতের আলু রোপণ করা প্রায় শেষের পথে। আগাম জাতের আলু প্রায় ৬০ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। আলুর বীজ, সার ও কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধির ফলে একর প্রতি খরচ প্রায় ১,৫০,০০০ থেকে ১,৮০,০০০ টাকা। যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে এবং ফলন ভালো হয়, তবে একর প্রতি আলুর আশা করা হচ্ছে প্রায় ২৭,০০০ কেজি। বাজারে ১২,০০০ টাকা প্রতি মেট্রিক টনে বিক্রি হলে আয় প্রায় ৩,২০,০০০ টাকা হবে, যা খরচের দ্বিগুণ লাভের সম্ভাবনা রাখে।
বিভিন্ন চর এলাকার আলু চাষি বাবলু মিয়া, শাহাজাহান আলী, মোকছেদুল ইসলাম, নুর ইসলাম, মাহাম্মদ আলী, শফিকুর রহমান ও এমদাদুল হক সহ আরও অনেকেই জানান, প্রতি বছর বন্যার কারণে ফসলাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখানকার কৃষকদের আলু চাষে আগ্রহ বাড়েছে। এখানকার মাটিতে আলু, বাদাম, মরিচ, পেঁয়াজ সহ বিভিন্ন ফসল ভালো হয়। এখন চরে আলু ও বাদাম চাষ চলছে এবং আগাম আলু আগেই উঠানো যাবে, ফলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া সম্ভব হবে।
চরাঞ্চলে আলু লাগানোর কাজে নিয়োজিত মহিলা শ্রমিকরা চায়না বেগম (৩৮), সুখিরন (৪০) ও ছমিরন (৩৫) সহ আরও অনেকেই জানিয়েছেন, তিস্তার চরাঞ্চলে আলু লাগানোর কাজ চলছে। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, যা দিয়ে সংসার পরিচালনা করা কঠিন। আলু চাষিরা অনেক লাভবান হলেও, মজুরি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল জানান, তিস্তার চরাঞ্চলে আলু চাষিরা আগাম আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আগাম আলু চাষে ফলন ও দামে ভালো থাকায় আলু চাষিরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। আলু চাষিদের বিভিন্ন ধরনের রোগ, বালাই ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া অব্যাহত রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, এখন যে জমিতে কৃষকেরা আলু লাগাচ্ছেন, তা ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে তুলে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হবে। মৌসুমের শুরুতে নতুন আলুর চাহিদা থাকায় বাজারে দাম উচ্চ থাকে। চরাঞ্চলের বালুমিশ্রিত পালি মাটিতে আগাম আলুর ফলন ভালো হয়, তাই কৃষকেরা আগাম আলু চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানে আমরা তৎপর রয়েছি।