মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চান বাবা-মা

প্রকাশকালঃ ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:৪৬ অপরাহ্ণ ০ বার পঠিত
মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চান বাবা-মা

ঢাকা প্রেস নিউজ
 

আজকের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নৃশংস ঘটনার সাক্ষী। ঠিক এক যুগ আগে, শত শত মানুষের সামনে এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হয়ে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বিশ্বজিৎ দাসকে। এই হত্যার পেছনে ছিল সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিচার হয়নি। তাই বিশ্বজিতের মা-বাবার আকুতি, অন্তত মৃত্যুর আগে যেন তারা ছেলের হত্যার ন্যায়বিচার দেখে যেতে পারেন।
 

ছেলের ছবির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন মা কল্পনা দাস। কিছুক্ষণ পর পর ছবি নামিয়ে আঁচলে মুছে পরম যত্নে পরিচ্ছন্ন করেন। ছবির দিকে তাকালেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যায়, আর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। মায়ের কান্না শুনে ব্যথিত হন বাবা অনন্ত দাসও। ছবির মতোই তাদের প্রিয় ছেলে এখন শুধুই স্মৃতি। ছেলের মুখ আর দেখতে পাবেন না, এটাই মেনে নিতে পারছেন না তারা।
 

ছোট্ট গ্রাম থেকে স্বপ্নের পথে
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মশুরা গ্রামের অনন্ত দাস ও কল্পনা দাসের ছোট ছেলে। ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের এই ছেলেটি আর্থিক অনটনের কারণে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ঢাকার শাঁখারী বাজারে দর্জির কাজ শিখেছিলেন। ভাইয়ের দোকানে কাজ করতে করতে নিজেও পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করেন। ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও মা-বাবাকে দেখতে প্রায়ই গ্রামে ফিরে আসতেন।

 

মৃত্যুর দিনটির বিভীষিকা
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির সময় ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় প্রকাশ্যে, দিবালোকে শিবির সন্দেহে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্বজিতকে। এই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রফিকুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের মাহফুজুর রহমান নাহিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মীর নূরে আলম লিমনসহ ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতাকর্মী।

 

বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় আট জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। আর দুই জনের ফাঁসির আদেশ দীর্ঘ ১২ বছরেও কার্যকর হয়নি।

 

মা-বাবার আর্তনাদ
বিশ্বজিতের মা কল্পনা দাস বলেন,
"আমার ছেলে কোনো দিন রাজনীতি করেনি। সংসার চালানোর জন্য কাজ করত। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে আমার ছেলেকে মেরে ফেলল। আজ ১২ বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু বিচার হলো না। অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা বিচার চাইতে চাইতে ক্লান্ত।"

 

বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাস বলেন,
"আমাদের ছেলে আমাদের ভরণপোষণ দিত। প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো, কিন্তু ১২ বছরেও বিচার পেলাম না। যদি জীবদ্দশায় ছেলের হত্যার ন্যায়বিচার দেখতে পারি, তাহলে অন্তত মরে শান্তি পাব।"

 

মানবাধিকার কর্মীর মন্তব্য
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান বলেন,
"বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনা আমরা দেখেছি। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাও সবার জানা। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগেও অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হয়নি। আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।"

 

বিশ্বজিৎ দাস হত্যার বিচার নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা শুধু তার পরিবারের নয়, সমাজের জন্যও একটি অমোচনীয় ক্ষত। তাই মানবতার স্বার্থে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।