ঢাকা প্রেস,মো: আবুল খায়ের:-
ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আবারও এসেছে শীতের মৌসুম। প্রতি বছরই শীতকাল আসে খেজুরের রস, বিভিন্ন ফুল-ফল, সবজি এবং পিঠা-পুলির স্বাদ নিয়ে। শীতকাল মানেই খেজুর রসের সর ও পিঠা-পুলির আমেজ।
বাংলাদেশের সন্দ্বীপ উপজেলা, যা প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো একটি দ্বীপ, খেজুর রস ও পিঠার ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। পনের থেকে বিশ বছর আগেও শীতের কুয়াশায় ঢাকা সন্দ্বীপের সকালগুলো খেজুরের রস ছাড়া জমত না। শিশির ভেজা সকালে খেজুর রসের চায়ের এক চুমুকে মানুষ সারাটা দিন কাটিয়ে দিত হাসিখুশিতে।
তবে, গ্রাম-বাংলার সেই ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। শীতকালের খেজুর রসের ম-ম গন্ধ আর গাছ থেকে রস সংগ্রহের সময় ছুটে আসা মাছির ভনভন শব্দ এখন আর আগের মতো শোনা যায় না। একইভাবে মাটির চুলায় বসে শিশু-বৃদ্ধদের পিঠা খাওয়ার উৎসব এবং রসের পিঠার ধুমও ক্রমশ অতীতের স্মৃতি হয়ে উঠছে।
বাংলা আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু হয়, তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়, কারণ তখন শীতের প্রকোপ বেশি থাকে। আবহাওয়া যত ঠান্ডা হয়, রসের পরিমাণ তত বাড়ে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে রসের রং হয়ে যায় হালকা গোলাপি। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ কমতে থাকে। বিগত ২০ বছরে খেজুর গাছের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে।
আগে শীতের মৌসুম শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই গাছিরা খেজুর গাছ কাটার প্রস্তুতি নিয়ে রাখত। সারাবছর অযত্নে পড়ে থাকা গাছগুলো তখন বিশেষ যত্ন পেত। খেজুর রস বিক্রি করে গাছিরা জীবিকা নির্বাহ করত। কোনো কোনো গ্রামে গাছিরা রসের অর্ডার নিতে শুরু করত শীতের আগমনের আগেই। সন্দ্বীপের মগধরা, মুছাপুর ও হারামিয়া ইউনিয়নে এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেত। গাছের পাশে দিয়ে হাঁটার সময় রসের ম-ম গন্ধ আর মাছির ভনভন শব্দ জানান দিত শীতের আগমনের।
সারিবদ্ধ খেজুর গাছের লাইন, গ্রামে গ্রামে রস দিয়ে পিঠা তৈরির উৎসব, গাছিদের কাঁধে করে হাঁটায় আনা হাঁড়ি হাঁড়ি রস, এই সবই বাংলার একটি পুরোনো সংস্কৃতির অংশ। শীত যত বাড়ত, পিঠা আর রসের খির খাওয়ার আনন্দও তত বাড়ত।
কবি সুফিয়া কামাল একে খুব সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করেছেন:
"পৌষ পর্বণে পিঠা খেতে বসে,খুশিতে বিষম খেয়ে।
বড় উল্লাস বাড়িয়াছে মনে, মায়ের বকুনি খেয়ে।"
শীতকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুর রস। এর সুগন্ধ আর স্বাদে মোহিত না হওয়ার মতো কেউ নেই। খেজুর রসে তৈরি হয় নানা রকমের পিঠা ও গুড়, যা সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। খেজুর রসে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম থাকায় এটি ক্লান্তি দূর করে, এছাড়াও এতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।
কিন্তু, গত কয়েক বছরে খেজুর গাছের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নগরায়নের কারণে গাছিরাও হারিয়ে যাচ্ছে। যেসব গ্রামে এখনও কিছু গাছ আছে, সেখানেও গাছির অভাবে আগের মতো আর রস সংগ্রহ হয় না। যারা এখনও এ কাজ করছেন, তারা রস ও গুড় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ক্রেতার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মানুষ গাছ কেটে ঘর নির্মাণ বা জ্বালানি সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করছে, ফলে গাছিদের আগ্রহও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
খেজুর রসের সেই ঐতিহ্য, যা একসময় শীতকালের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল, এখন বিলুপ্তির পথে।