|
প্রিন্টের সময়কালঃ ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৫০ অপরাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মিলছে না ইলিশ সাগর ও নদীতে, দেড় হাজার জেলেদের দুর্দিন


চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মিলছে না ইলিশ সাগর ও নদীতে, দেড় হাজার জেলেদের দুর্দিন


ট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দেড় হাজার জেলে পরিবারে দুর্দিন চলছে। দেশের চারটি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রের একটি এখানকার বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল (হাইতকান্দি-শাহেরখালী) এলাকায় হলেও ভরা মৌসুমেও মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ।

সাগর ও নদীতে ইলিশ মিলছে না, জেলেদের দুর্দিনসম্প্রতি সরেজমিনে শাহেরখালী ও ডোমখালী জেলেঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের পর থেকে দূর-দূরান্ত থেকে ইলিশ কেনার আশায় মাছ ব্যবসায়ীরা সাগর থেকে জেলেদের ফেরার অপেক্ষায় আছেন। বিকেল গড়ালে একের পর এক জেলেদের মাছ ধরার নৌকা কিনারে ভিড়লেও পরিমাণমতো মাছ পায়নি।

ওই সময় দেখা গেছে, কোনো কোনো নৌকায় দু-তিন কেজি ইলিশ, আবার কোনো নৌকায় ইলিশ নেই। স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, এখানকার সাগর উপকূলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নকাজে সাগর থেকে অতিমাত্রায় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন এবং মালবোঝাই লাইটার জাহাজের আনাগোনা বেড়েছে। ফলে সাগরে জাল ফেলতেও অসুবিধে হচ্ছে। এ ছাড়া আগের মতো মাছের দেখা মিলছে না।


স্থানীয় মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মিরসরাইয়ে ২০১৮ সালে ইলিশ আহরণ হয় ৩৪২ টন। ২০১৯ সালে ৩২২ টন। ২০২০ সালে প্রায় ৩২৬ টন। ২০২১ সালে প্রায় ২৫২ টন।

২০২২ সালে ১৪৭ টন। ২০২৩ সালে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী আগস্ট পর্যন্ত ইলিশ আহরণ করা হয়েছে ৩৭.৩ টন। মিরসরাই উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাল জলদাস অভিযোগ করেন, ‘বালু তোলার কারণে এখানে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

মিরসরাই উপজেলা মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, এখানকার ডোমখালী, শাহেরখালী ও মঘাদিয়া ঘাট হয়ে জেলেরা প্রতিবছর সাগর থেকে মাছ আহরণ করে থাকে। এখানে সবচেয়ে বেশি মেলে ইলিশ।


প্রতিবছর ৬৫ দিন সরকারিভাবে সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ রাখা হয়। এ সময় জেলেদের সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এখানকার দুই হাজার ২৬ জন জেলে মৎস্য অফিসের নিবন্ধনের আওতায়। আরো ৬০০ জন নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন।

মিরসরাই উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিল্পায়নকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড মাছ বিচরণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিবেশকে হয়তো বিঘ্নিত করছে। যার ফলে এ অঞ্চল হতে মাছ অন্য অঞ্চলে সরে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এর সঠিক কারণ নির্ণয় করা তাত্ক্ষণিক সম্ভব নয়। বরং এটি গবেষণার দাবি রাখে।’


মাঝে ৬৫ দিন মাছ ধরার ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে রুটি-রোজগার বলতে সরকারের দেওয়া মাত্র ৫০ কেজি চাল। এর মধ্যে জাল কেনা-বুনন, নৌকা মেরামত সবই হয়েছে উচ্চ হারে সুধের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে। তার ওপর মধ্যস্বত্বভোগীদের দাদনের দেনায় দিশাহারা এখানকার প্রায় দেড় হাজার জেলে পরিবার। শিমুল চন্দ্র দাস, মনোরঞ্জন জলদাস, সুধন জলদাস, শুকলাল জলদাসসহ অসংখ্য জেলের কথায় মেলে এমন তথ্য।

মিরসরাই উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাল জলদাস বলেন, ‘উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। তাদের বেশির ভাগের পেশা সাগরে মাছ ধরা। এ মৌসুমে মাছের আকাল। জেলে পরিবারগুলো দিশাহারা।’


ভরা মৌসুমেও পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মাছঘাটে জেলে, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভিড় নেই। নদী ইলিশশূন্য হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম হতাশায় রয়েছেন জেলেরা। তেঁতুলিয়া নদীপারের বাউফল উপজেলার চর কালাইয়া থেকে দশমিনা উপজেলার হাজীরহাট লঞ্চঘাট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকার জেলেপল্লীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ইলিশ না পাওয়ার আক্ষেপই শোনা গেছে। তবে নদীতে আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়ার কারণ হিসেবে বৃষ্টিপাত কম ও জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করেছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।  

সাগর ও নদীতে ইলিশ মিলছে না, জেলেদের দুর্দিনজেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশ শিকারের ভরা মৌসুম মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এ সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ সাগর থেকে মিঠা পানিতে ছুটে আসে। অক্টোবর মাসে নিষেধাজ্ঞার সময় নদীতে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তা তিন থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে ‘বাঁধা’ কিংবা ‘ব্যার জাল’ দিয়ে ছোট ইলিশ শিকার করা হয়। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত ছোট ফাঁসের কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন অসাধু জেলেরা। এই জাল দিয়ে শুধু চাপিলা শিকার করা হয়। ওই চাপিলাই মূলত ইলিশের বাচ্চা। এ কারণে দিন দিন ইলিশের সংখ্যা কমে গিয়ে চলতি মৌসুমে শূন্যে চলে এসেছে। তা ছাড়া চর পড়ে গভীরতা কমে যাওয়ায় ইলিশের বিচরণ এখন নদীতে নেই। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তো আছেই। নদীতে ইলিশ না থাকায় মাসের পর মাস সারিবদ্ধভাবে ডাঙায় নোঙর করে আছে জেলেদের নৌকা। এমন দৃশ্য উপকূলের নদীসংলগ্ন বিভিন্ন খালে এখন অহরহ চোখে পড়ে।

পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীপারের বাঁশবাড়িয়া গ্রামের জেলে মো. ওহিদ (৪০) বলেন, ‘প্রত্যেক বচ্ছর এমন দিনে ডেলি ১০-৩০ কেজি পর্যন্ত ইলিশ পাইছি। এই বচ্ছর নদীতে ইলিশ নাই। গত ১০ দিনে মাত্র পাঁচটা জাটকা পাইছি, যার বাজারমূল্য ৫০০ টাকা। অথচ গত ১০ দিনে নদীতে জাল ফালাতে ও ওঠাতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা।’


পটুয়াখালীর মহিপুর আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজা আহম্মেদ রাজু বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর এ সময় দিনে অন্তত ১০০ মণ ইলিশ আড়তদারদের দিয়েছেন জেলেরা। এ বছর ৪০-৪৫ মণের বেশি দিতে পারছেন না। ফলে ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে।’

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. সাজেদুল হক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি আমরা নিজেরাও ইলিশ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কম দায়ী নই। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা পালনে আমাদের আরো বেশি কঠোর হতে হবে। ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এসব ব্যাপারে জেলেদের আরো বেশি সচেতন করে তুলতে হবে।’

নদীতে ইলিশ কম থাকার কথা স্বীকার করে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছর বৃষ্টিপাতের সময়টা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ বছর জুন-জুলাইতে বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি পিছিয়েছে এক থেকে দেড় মাস। ফলে ইলিশের প্রজনন সময় পিছিয়েছে এখন সাগরে থাকা ইলিশের ডিম কেবল পরিপক্ব হতে শুরু করেছে। পরিপূর্ণ পরিপক্ব হলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মিঠা পানিতে উঠে আসবে  আশা করি, শিগগিরই ইলিশের সংকট কেটে যাবে।’


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫