কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক হামলাকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর অপচেষ্টা

প্রকাশকালঃ ১৬ আগu ২০২৪ ০৭:৪৭ অপরাহ্ণ ৫৬৩ বার পঠিত
কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক হামলাকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর অপচেষ্টা

ঢাকা প্রেস
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-

 

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ও তাদের অনেকের বসতবাড়িসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। স্বল্প পরিসরে হলেও কুড়িগ্রামও এমন রাজনৈতিক আক্রোশের আগুনে পুড়েছে। সদ্য সা‌বেক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে দলবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপর ‘নিপীড়ন’ করেছেন এমন নেতাকর্মীরাই আক্রোশের শিকার হয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ‌বেশ‌ কিছু রাজনৈতিক কর্মী এবং তাদের পরিবার।

 

রাজনৈতিক আক্রোশের জেরে সংঘটিত এসব হামলাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ রঙ দিয়ে ‘সংখ্যালঘুর ওপর হামলা’ বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। ৯ আগস্ট এই দুই সংগঠন কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত তালিকায় ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের রাবাইতারি গ্রামের মনোরঞ্জন সেন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। সরেজমিনে মনোরঞ্জন সেনের বাড়িতে গিয়ে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে মনোরঞ্জন সেনের ছোট ভাই চিত্তরঞ্জন সেনের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হামলায় বাড়ির কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সেখানে লুটপাটের কোনও ঘটনা ঘটেনি।

 

বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে রাবাইতারি গ্রামে মনোরঞ্জন সেনের বাড়িতে গেলে তার দেখা পাওয়া যায়নি। মনোরঞ্জনের পুত্রবধূ লাবন সরকার মানসি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনার দিন বাবা (শ্বশুর) বাড়িতে ছিলেন না। চাচা শ্বশুরের (চিত্তরঞ্জন সেনের) বাড়িতে হামলার সময় আমাদের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করেছিল। ঢিলে একটি জানালার কাচ ভেঙে যায়। কিন্তু শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জানার পর আর হামলা করেনি কেউ।’

 

হামলা-ভাঙচুরের শিকার চিত্তরঞ্জন সেন বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকালে বিএনপি সমর্থক এলাকার কিছু লোকজন- যাদের বেশিরভাগই যুবক, তারা বাড়িতে হামলা করেছিল। কিছুক্ষণ ভাঙচুরের পর আমি তাদের অনুরোধ করি আর ভাঙচুর না করতে। তখন তারা চলে যায়। আমাদের গ্রামে আরও কয়েকটি পরিবারে হামলা হয়েছে। তবে তারা মুসলিম পরিবার। আমরা ছাড়া অন্য কোনও হিন্দু পরিবারে হামলা হয়নি।’

 

আপনার বাড়িতে কেন হামলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘কেন হামলা করেছে, আমি জানি না। আমি কৃষক, রাজনীতি করি না। তবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিই। আমার ছেলে শুভ্রজিৎ। সে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিল। তবে ২০২২ সালে পদ ছেড়ে দেয়। আক্রোশ আমার ছেলের ওপর নাকি আমার ওপর, সেটা জানি না।’

 

‘বাড়িতে শুধু আমি ছিলাম। তারা আমার ওপর হামলা করেনি। আমি অনুরোধ করেছিলাম ভাঙচুর না করার। পরে তারা চলে গেছে। আমার দোকানেও হামলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির লোকজন তা হতে দেয়নি। পরে তাদের সহায়তায় দোকান খুলেছি। যাদের ইন্ধনে হামলা হয়েছে, তারাই আবার এখন এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে’ যোগ করেন চিত্তরঞ্জন।

 

রাবাইতারি গ্রামে প্রায় দুই থেকে তিনশ হিন্দু পরিবারের বসবাস। চিত্তরঞ্জন সেনের বাড়িতে হামলা হলেও তার প্রতিবেশী অন্য কোনও হিন্দু পরিবার হামলার শিকার হয়নি। একই গ্রামে হামলার শিকার হয়েছেন দিনমজুর আব্দুস ছামাদ ও নজির হোসেন। সামাদের ছেলে রাসেল এবং নজিরের ছেলে সবুজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মূলত ছেলেদের রাজনৈতিক কারণে পরিবারগুলো প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তারা বলেছেন, ‘এসব হামলা রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক নয়।’

 

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘উপজেলায় শুধু একটি হিন্দু পরিবার হামলা-ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। সেটি সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। রাজনৈতিক কারণে হামলা হয়েছে। তবে সেখানে কোনও প্রতিমা ভাঙচুর বা লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।’

 

এই হামলাকে সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘুর ওপর হামলা বলার কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে অনীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি স্থানীয় প্রশাসনকেও একই কথা জানিয়েছি। তবে আমরা কোনও ধরনের হামলাকে সমর্থন করি না। রাজনৈতিক হামলাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে কেউ ফায়দা হাসিল করতে চাইলে তার নিন্দা জানাই।’

 

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর কু‌ড়িগ্রা‌মের বি‌ভিন্ন স্থা‌নে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বসতবা‌ড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা‌নে হামলার ঘটনা ঘ‌টে। 

 

কু‌ড়িগ্রাম-৪ আস‌নের সা‌বেক সংসদ সদস্য প্রাথ‌মিক ও গণ‌শিক্ষা মন্ত্রণাল‌য়ের সা‌বেক প্রতিমন্ত্রী জা‌কির হো‌সেনের রৌমারী উপ‌জেলার বা‌ড়ি ভাঙচুর ক‌রে অ‌গ্নিসং‌যোগ ক‌রে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার মা‌লিকানাধীন ক‌য়েক‌টি ট্রাক ও জিপ গা‌ড়ি আগু‌নে পু‌ড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তার ক‌য়েক‌টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা‌নে ভাঙচুর ও লুটপা‌টের ঘটনা ঘ‌টে। একই উপ‌জেলার বা‌সিন্দা ও সদ্য সা‌বেক সংসদ সদস্য ‌বিপ্লব হাসান পলা‌শের বা‌ড়ি‌তেও ভাঙচুর এবং লুটপাট চালা‌নো হ‌য়ে‌ছে। হামলা-ভাঙচুর হ‌য়ে‌ছে সদর, ভূরুঙ্গামারী, চিলমারী, রা‌জিবপুর, না‌গেশ্বরী, ফুলবাড়ী উপ‌জেলার আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মী‌দের বা‌ড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা‌নে। ত‌বে সরকার পত‌নের পর হওয়া এসব হামলায় হতাহ‌তের কোনও খবর পাওয়া যায়‌নি।