কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের পুশইন মে মাসেই ১১৬

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশইনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের মে মাসে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম দিয়ে ১১৬ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।পুশইনের ঘটনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের মধ্যে প্রায়ই বাড়ছে উত্তেজনা।
বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ, বিজিবি ও এলাকাবাসীর মধ্যে বাক বিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও জামালপুর বিজিবি এসব তথ্য-উপাত্ত নিশ্চিত করেছে।
বিজিবির তথ্য-উপাত্ত বলছে, কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে স্থল ও নদী পথ মিলিয়ে ভারতের সাথে সীমান্ত রয়েছে ৭ উপজেলায়। এসব সীমান্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুশইন হচ্ছে রৌমারী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী সীমান্তে। সীমান্ত দিয়ে চলতি মে মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশইন হয়েছে ১১৬ জন। এর মধ্যে ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে ৪ দফায় ৫৪ জন, রৌমারী সীমান্তে ৩ দফায় ৫০ জন এবং ফুলবাড়ী সীমান্তে ২ দফায় ১২ জন।
এই ৩ সীমান্তের দায়িত্বে রয়েছে যথাক্রমে কুড়িগ্রাম ২২ বিজিবি, জামালপুর ৩৫ বিজিবি ও লালমনিরহাট ১৫ বিজিবি। এই মোট সংখ্যার মধ্যে ১৪ জন আছেন ভারতীয় নাগরিক। গত ২৭ মে রৌমারীর বড়াইবাড়ি সীমান্ত দিয়ে তাদের রাতের আধারে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ। আর বাকি ৯৮ জন রোহিঙ্গা। বিজিবি বলছে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় প্রতি রাতেই ভারতীয় বিএসএফ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে পুশইন করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে স্থানীয়দের সহায়তায় বিজিবি বেশ কিছু পুশইন ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে।
সাম্প্রতিক পুশইন হওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদকের সাথে।কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ঘোগারকুটি গ্রামের দিনমজুর রুবেল মিয়া (২৭)। অভাবের সংসারে একটু স্বচ্ছলতার আশায় স্ত্রী রোকসানা বেগম (২১) ও শিশু কন্যা রুবাইয়াকে সাথে নিয়ে দালালের সহযোগিতায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দিল্লিতে যান। সেখানে গিয়ে সাত বছর ধরে বিভিন্ন ইটভাটায় স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করেন। সেখানে আরেক সন্তান খাদিজার (১) জন্ম হয়। দুই জনে মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় দুই লক্ষ টাকা জমা করেন। তাদের স্বপ্ন ছিল সেই টাকা নিয়ে দেশে ফেরত আসবেন।
সাম্প্রতিক সময়ের ইটভাটা গুলোতে দিল্লি পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। পুলিশি অভিযানে আটক হন রুবেল মিয়া ও তার পরিবার। চলতি মাসের শুরুর দিকে আটক করে সেখানকার একটি স্কুল ঘরে রাখা হয়। সেখানে একমাস আটক রাখার পর তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে রাতের আঁধারে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধর্মপুর সীমান্ত দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে পুশইন করে বিএসএফ। শূন্য হাতে শুধুমাত্র পড়নের কাপড় নিয়ে নিজ বাড়ি ঘোগারকুটিতে ফেরত আসেন রুবেল মিয়াও তার পরিবার।
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের উত্তর বড়ভিটা গ্রামের হতদরিদ্র দিনমজুর আব্দুল জলিল। ২০১৫ সালে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করতে আগে থেকে ভারতের থাকা ভাগিনা জাহিদুলের সহযোগিতায় দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। এ সময় তিনি সঙ্গে নেন স্ত্রী সাফিয়া বেগম (৩৩), ছেলে সফিয়ার (২২) মেয়ে জেসমিনকে (৯)। ভারতে গিয়ে ভাগিনা জাহিদুলের সহযোগিতায় আব্দুল জলিল তার পরিবার নিয়ে বিহার, হরিয়ানা ও রাজস্থানের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করেন। দেখতে দেখতে কেটে যায় দশ বছর। এর মধ্যে আব্দুল জলিল আরও দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। সেখানেই তার বড় ছেলে সফিয়ারের কেও বিয়ে দেন। তারও কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। গোটা পরিবার নিয়ে রাজস্থানের একটি ইটভাটায় থাকতেন আব্দুল জলিল। গত ৪ মে রাজস্থান পুলিশ সেখানে অভিযান চালালে পরিবারের ৯ জনসহ স্বেচ্ছায় ধরা দেন আব্দুল জলিল। ধরা দেয়ার পর পুলিশ ২২ দিন তাদের এক স্কুল ভবনে রাখে। সেখানে আটকে রেখে বাংলাদেশে থাকা আব্দুল জলিলের বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে পরিচয় নিশ্চিত করে রাজস্থান পুলিশ। এরপর আব্দুল জলিলের পরিবারকে প্রথমে জোধপুর বিমানবন্দরে আনা হয়। সেখান থেকে বিমানযোগে কলকাতা আনা হয়। কলকাতা আনার পর বাসযোগে তাদের আনা হয় সিলেট মৌলভীবাজার সীমান্তে। সেখানে এনে পুলিশ তাদেরকে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। বিএসএফ তাদেরকে গভীর রাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঠেলে পাঠায়।
পরে সীমান্তে টহলরত বিজিবি তাদের আটক করে বড়লেখা থানায় সোপর্দ করে। সেখানে থেকে আব্দুল জলিল বড়ভাই জালাল মিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন। জালাল মিয়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বড়লেখা থানায় যান। পরিচয় সনাক্তের পর আব্দুল জলিলের গোটা পরিবারকে তার বড় ভাইয়ের জিম্মায় ছেড়ে দেয় বড়লেখা থানা পুলিশ।
মানবাধিকার কর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, 'ভারত সরকার যদি মনে করে তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি বা অন্য কোন দেশের মানুষ আছে, তাহলে তারা আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু এভাবে রাতের আধারে যখন-তখন জোর করে তারা বাংলাদেশের ঠেলে দিতে পারে না। তাদের দেশে যারা আশ্রিত রোহিঙ্গা আছে তারা তাদের ব্যাপারে ইউনাইটেড ন্যাশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজি (UNHCR) এর সহযোগিতা নিতে পারে। (UNHCR) তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করবে।
রোহিঙ্গারা তাদের দেশে থাকবে, না অন্য কোন দেশে বা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করবে। আর তাদের দেশের নাগরিককে তারা যদি জোর করে বাংলাদেশে প্রেরণ করে, বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতীয় হাই কমিশনের সাথে অতি তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করা। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এই কাজকে অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।'
নাম না প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থার প্রোগ্রাম ম্যানেজার বলেন, 'সাম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশে যেসব পুশইন হচ্ছে এটা তাদের বেআইনি প্রক্রিয়া। আমি মনে করি এতে করে দুই দেশের সম্পর্ক আরো অবনতি হচ্ছে। ভারত সরকারের এটা একটা নিন্দনীয় কাজ।'
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জামালপুর ৩৫ বিজিবি'র অধিনায়ক লে. কর্নেল নজরুল ইসলাম বলেন, "ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তাদের দেশে আশ্রিত নর-নারী ও রোহিঙ্গাদেরকে সম্প্রতি রৌমারীর বড়াইবাড়ী সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে পুশইনের চেষ্টা করেছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি এবং পতাকা বৈঠকে সমাধানের চেষ্টা করছি। বিএসএফ'র পুশইন রুখে দিতে বিজিবি সর্বোচ্চ এলার্ট রয়েছে। এ ছাড়াও এ বিষয়ে স্থানীয়দের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। বর্তমানে বিজিবি ও স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে রৌমারীর বড়াইবাড়ী সীমান্তে পুশইন ঠেকাতে একাত্ম বলেও জানান তিনি।"
কুড়িগ্রাম ব্যাটালিয়ন (২২ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মাহবুব-উল-হক জানান, কুড়িগ্রাম সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তার মধ্যে অন্যতম হলো, জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার, গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, সীমান্তে সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হলে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে বিজিবিকে সংবাদ প্রদান করে তথ্য দেয়ার জন্য স্থানীয় জনসাধারণকে অনুরোধ প্রভৃতি।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫