ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বিরোধে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

প্রকাশকালঃ ০১ জুন ২০২৪ ০৫:০১ অপরাহ্ণ ৯৪৩ বার পঠিত
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বিরোধে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বিরোধে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে পাল্টা কমিটি দিয়েছেন বিদ্রোহীরা। দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সংগঠনে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে এবং দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।


ইউরোপের একাধিক দেশের বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এখন বিদেশে দল ও দেশের পক্ষে ভূমিকা রাখার চেয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াচ্ছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন দেশে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন করেছেন। ফলে ইউরোপে দেশবিরোধী নানা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কমিউনিটির মধ্যে বিভক্তি থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাংলাদেশের পক্ষে নীতিনির্ধারণে জোরালোভাবে চাপ দেওয়া যাচ্ছে না।


আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, বিদেশে আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোকে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুমোদন দেওয়া হয় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মতামত নিয়ে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ ইউরোপের দেশগুলোর কমিটি অনুমোদন দেয়।জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগের একাধিক কমিটি রয়েছে, যেগুলো আমরা স্বীকৃতি দিইনি। একটা কমিটির অনুমোদন দেওয়া হলে আরো কয়েকটা কমিটি করা হয়।


এটা শৃঙ্খলা পরিপন্থী। একটা জায়গায় তিন-চারটা বঙ্গবন্ধু পরিষদও করা হয়। এমন তো হতে পারে না। একটা বৈধ কমিটির মাধ্যমে পুরো বিষয়টি পরিচালিত হলে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। সব ক্ষেত্রে একটা কমিটিই হওয়া উচিত। ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ইউরোপের দেশগুলোতে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল নয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে অনুমোদন নেওয়া হয়। বেশির ভাগ দেশেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ অনুমোদন দেয়। প্রতিবছরই তা নবায়ন করতে হয়। সংগঠনের গঠনতন্ত্রে বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে অনুমতি চাওয়া হয়।

 

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ বেশির ভাগ দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ রয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নির্দেশনা অনুসারে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ যেসব কমিটি অনুমোদন দিয়েছে. সেগুলোর বিরুদ্ধে অন্তত সাত-আটটি দেশে পাল্টা কমিটি দেওয়া হয়েছে।

 

ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, সাধারণত পদবঞ্চিত হাতে গোনা কয়েকজন নেতা মিলে পাল্টা কমিটি দেন, কিন্তু পরে আর সেভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন না। কিন্তু দলকে তাঁরা বিভক্ত করে ফেলেন। জার্মান আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, জার্মানিতে আওয়ামী লীগের দুটি কমিটি রয়েছে। একটির সভাপতি বসিরুল আলম চৌধুরী সাবু ও সাধারণ সম্পাদক আব্বাস আলী চৌধুরী। আরেকটি কমিটির সভাপতি মিজানুর হক খান ও সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল। সাবু ও আব্বাসের কমিটি অনুমোদন দেয় সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ।

 

বসিরুল আলম চৌধুরী সাবু ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে। তাঁর বিরুদ্ধে পদ বাণিজ্য, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের কমিটিতে রাখার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়ান সাবু। এ ছাড়া তিনি রাজধানী বার্লিনকেন্দ্রিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড গড়ে তুলতে পারেননি। সাবু মূলত ফ্রাংকফুর্ট ও বানকেন্দ্রিক সংগঠন পরিচালনা করতেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চাইছিলেন বার্লিনকেন্দ্রিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোক। এসব কারণে গত বছর মিজানুর ও বকুলের নেতৃত্বাধীন কমিটি অনুমোদন দেয় সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ।

 

দলীয় একাধিক সূত্র মতে, জার্মান আওয়ামী লীগের পুরনো নেতা বসিরুল আলম চৌধুরী সাবুর কমিটিতে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হাবিবুর রহমান হাবিবকে (ইউটিউবার নাটালিয়া হাবিব) প্রচার সম্পাদক পদ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক ওঠে। হাবিব একসময় শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিউনিখ সফরে গেলে তাঁর হোটেলের বাইরে নিজ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হন আব্বাস আলী চৌধুরী। টাকা নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে না দেওয়ার অভিযোগ ছিল আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে।

 

জানতে চাইলে সাবু-আব্বাস কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্বাস আলী চৌধুরী বলেন, ‘এটা জাতীয় পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার মতো কোনো ঘটনা না।’ জার্মান আওয়ামী লীগে কোন্দলের প্রসঙ্গে মিজানুর-বকুল নেতৃত্বাধীন কমিটির সভাপতি মিজানুর হক খান বলেন, ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছি। সবাই একসঙ্গে থাকলে হয়তো আরেকটু ভালো ভূমিকা রাখা যেত। বাংলাদেশ থেকে যদি আনুষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো পাল্টা কমিটি ঘোষণা বন্ধ করা যেত।’

 

দীর্ঘদিন ইতালি আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে একটি কমিটির অধীনেই কাজ করে আসছিল। কিন্তু তিন বছর আগে সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে সেখানকার নেতাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইদ্রিস ফরাজী সভাপতি ও হাসান ইকবাল সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন। সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ এই কমিটিকে অনুমোদন দেয়। তবে এর কয়েক দিন পরই পাল্টা সম্মেলন করে সংগঠনের একটি অংশ। তারা মাহতাব হোসেনকে সভাপতি ও আলমগীর হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে পাল্টা কমিটি গঠন করে।

 

ইতালি আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, গত দুই বছরে নানা চেষ্টা করেও দুই পক্ষের বিরোধ মেটানো যায়নি। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ যাঁরা পাল্টা কমিটি গঠন করেন তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এতেও বিরোধ মেটেনি। সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের অনুমোদিত কমিটির সভাপতি ইদ্রিস ফরাজী বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেন। রাজধানীর বনশ্রীতে ফরাজী হাসপাতালের মালিক ইদ্রিস ফরাজী এখন বাংলাদেশে রাজনীতিতে অবস্থান গড়তে চাইছেন। ফলে তাঁকে সভাপতি হিসেবে ইতালি আওয়ামী লীগের কোনো পক্ষই মানতে চাইছে না।

 

পাল্টা কমিটি গঠনকারী মাহতাব ও আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিরোধ শুরু হয়েছে। গত ৫ মে তাঁদের বিরুদ্ধে রোমে এক সংবাদ সম্মেলন করেছে সংগঠনের একটি অংশ। তারা মাহতাব ও আলমগীরের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তোলে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইতালি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান ইকবাল বলেন, ‘আমাদের সাংগঠনিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে প্রধানমন্ত্রীর অর্জনগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা। প্রবাসী ভাইদের সমস্যায় তাঁদের পাশে থাকা। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ যেন আমরা না করি।’

 

ইউরোপের আরেক প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সেও আওয়ামী লীগের একাধিক কমিটি রয়েছে। একটির সভাপতি এম এ কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক দিলওয়ার হোসেন কয়েছ। আরেকটির সভাপতি সুনাম উদ্দিন খালেক ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। কাশেম ও কয়েছের নেতৃত্বাধীন কমিটি সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ অনুমোদিত। তারাই ফ্রান্স আওয়ামী লীগের মূল ধারা হিসেবে পরিচিত। এই কমিটিতে প্রথমে সভাপতি ছিলেন বেনজির আহমেদ সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক লিটন খান। তাঁরা দুজনই প্রয়াত হন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন কাশেম ও কয়েছ। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ফ্রান্স সফরের সময় এই দুই নেতাকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন। সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি চিঠিতে তাঁদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

২০১৯ সালে কাশেম ও কয়েছ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পরই পাল্টা কমিটি গঠন করেন কয়েকজন নেতাকর্মী। তাঁরা সুনাম উদ্দিন খালেককে সভাপতি ও নজরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা দেন। এই কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে এই কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর সমালোচক ও ফ্রান্সে বসবাসকারী পিনাকী ভট্টাচার্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্স আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সব পক্ষের বিরুদ্ধেই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক কমিটিতে জামায়াত সম্পৃক্ত ছিলেন—এমন ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

 

ইউরোপ আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি পোল্যান্ড আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়েও সেখানকার নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ চলছে। ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে দলের একটি অংশ। বিরোধ নিরসনে শিগগিরই তাদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ। সূত্র মতে, আগামী জুলাইয়ে পর্তুগাল আওয়ামী লীগের সম্মেলন হবে। সেখানকার নেতৃত্ব নিয়েও বিরোধ চলছে। শিগগিরই গ্রিস আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা হতে যাচ্ছে। কমিটি ঘোষণার পর সেখানেও বিরোধ দেখা যেতে পারে।

 

ইউরোপজুড়ে আওয়ামী লীগের বিভক্তি প্রসঙ্গে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত পদ না পেলেই কেউ কেউ দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করেন। এটি দুঃখজনক। আমরা যেকোনো দেশের সম্মেলনে ইউরোপের সব দেশের দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানাই। সবার উপস্থিতিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই কমিটি গঠন হয়। এর পরও কিছু লোক সমস্যা তৈরি করেন। এদের জন্য আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।’ এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সবার উচিত দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত থাকা। নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি কাম্য নয়।’ বিদেশে দলের বিরোধের বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।