প্রসঙ্গ: হলুদ সাংবাদিকতা --- এম. নজরুল ইসলাম খান

সংবাদপত্রকে সাধারণত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, আর সাংবাদিককে জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি এক মহান ব্রত। যেমন একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে দিকনির্দেশনা দেন, তেমনই সাংবাদিকরা সমাজ ও জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এই কারণে সাংবাদিকতা শুধুই পেশা নয়, বরং একটি দায়িত্বপূর্ণ ব্রত।
তবে প্রতিটি সাংবাদিক এই মহান কাজটি করে না। বর্তমানে এমনও সাংবাদিক রয়েছেন যারা জাতির বা দেশের ক্ষতি করছেন। প্রতিদিন আমরা যে ফেইক নিউজ, গুজব এবং হলুদ সাংবাদিকতা দেখতে পাই, তা দেশের এবং মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
হলুদ সাংবাদিকতা কী?
হলুদ সাংবাদিকতা হলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্যকর ও রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন, যার মূল লক্ষ্য থাকে পত্রিকার বিক্রি বা দর্শকসংখ্যা বাড়ানো; সাংবাদিকতার নৈতিকতা নয়। এই ধরনের সাংবাদিকতা তথ্য যাচাই না করে আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে এবং সাধারণ ঘটনাকেও অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে।
সাংবাদিকতার লক্ষ্য ও হলুদ সাংবাদিকতার প্রভাব
সাংবাদিকতা হলো সমাজের দর্পণ। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের ঘটনার সত্য উদঘাটন করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করাই এর প্রধান লক্ষ্য। সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান, তথ্য ও সচেতনতা অর্জন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার এই মহান পেশা নানা কারণে কলুষিত হচ্ছে। বিশেষ করে হলুদ সাংবাদিকতা সত্যকে বিকৃত করছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এবং সাংবাদিকতার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সংবাদপত্র বা মিডিয়ার লোগো ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক নিউজ ও বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অধিকাংশ সময়, আমরা যে সংবাদ পাই তা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। এই বিষয়ে আমাদের সকলেরই অত্যন্ত দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
হলুদ সাংবাদিকতার উৎপত্তি
“হলুদ সাংবাদিকতা” (Yellow Journalism) শব্দটি উনিশ শতকের শেষ ভাগে আমেরিকায় উৎপন্ন হয়। নিউ ইয়র্কের দুটি দৈনিক—New York World এবং New York Journal—একজন অপরজনের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অতিরঞ্জিত, চাঞ্চল্যকর ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। সেখান থেকেই “হলুদ সাংবাদিকতা” শব্দটি জনপ্রিয় হয়।
হলুদ সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য:
-
অতিরঞ্জিত শিরোনাম: পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সংবাদকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা।
-
গুজব বা যাচাইবিহীন তথ্য: সত্যতা যাচাই না করে গুজব ছড়ানো।
-
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনধিকার চর্চা: গোপন তথ্য ফাঁস করে চরিত্রহনন।
-
সংবেদনশীলতা উসকে দেওয়া: অশ্লীল ছবি, অপরাধ ও কেলেঙ্কারির খবর অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া।
-
সেন্সেশনালিজম: মূল সত্য আড়াল করে রসালো দিক বড় করে দেখানো।
সমাজে প্রভাব:
-
অস্থিরতা সৃষ্টি: যাচাইবিহীন খবর গুজব ছড়িয়ে দেয়, যা সংঘর্ষ বা আতঙ্ক ডেকে আনে।
-
নৈতিক অবক্ষয়: ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে মর্যাদা হানি ঘটায়।
-
গণতন্ত্রে ক্ষতি: সঠিক তথ্য না পেলে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
-
সাংবাদিকতার মর্যাদা হ্রাস: পেশাদার সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রতিরোধের উপায়:
-
পেশাগত প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহি: সাংবাদিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং আচরণবিধি প্রয়োগ।
-
গণমাধ্যম নীতিমালা কার্যকর করা: রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং ন্যায়সংগত নীতিমালা দ্বারা সঠিক সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করা।
-
পাঠকের সচেতনতা বৃদ্ধি: হলুদ সাংবাদিকতার ফাঁদে না পড়তে পাঠককে সচেতন করা।
সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করে, সত্য প্রকাশ করে। কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতা সেই আলোককে আড়াল করে অন্ধকার ছড়ায়। তাই সাংবাদিকদের উচিত পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা। শুধুমাত্র সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ পরিবেশন করে সাংবাদিকতা তার মর্যাদা ও আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে। নতুবা, এটি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা হারাবে।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫