আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার চর রসূলপুরের প্রান্তিক গৃহবধূ জেসমিন আরা। সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছেন চিকিৎসা সেবা নিতে। কিন্তু গত আট মাস ধরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রেসার মাপা ছাড়া আর কোনো সেবা পাচ্ছেন না তিনি। তালিকাভুক্ত ২৭টি ওষুধের এখন একটিও সরবরাহ নেই অধিকাংশ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। এমনকি আয়রণ বা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটও নেই। জেলার অর্ধশতাধিক নদ-নদী ও চার শতাধিক চরাঞ্চলের প্রান্তিক নারীরা প্রচণ্ড তাপদাহে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা না পেয়ে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।
কুড়িগ্রাম জেলার চরাঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক প্রান্তিক মানুষসহ প্রায় ১৮ লাখ মানুষ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বা স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোতে এসে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। গৃহবধূ জেসমিন আরার মতো নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের আমেনা, সাথি আক্তার ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রাহেলার মতো শত শত নারীরা প্রয়োজনীয় ওষুধ না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের কষ্টের কথা জানায়। তাদের কথা থেকে জানা গেল যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানেই সেবার এই বিপর্যয় প্রান্তিক মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রতিটি এলাকার চিত্র একই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের ঘাটতি ও জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসা সেবা কার্যত ভেঙে পড়েছে। জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক মো. মোদাব্বের হোসেন এদিন জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করছিলেন। তিনিও জানালেন দীর্ঘ আট মাস থেকে জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই। যারা সেবা নিতে আসছেন তাদের শুধু পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ওষুধ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলায় ৪০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, একটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য বিভাগ কেন্দ্রিক পরিচালিত ১৮টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (আরডি) গত ৮ মাস ধরে নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ, নেই পর্যাপ্ত জনবল। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জনবল সংকট ও ওষুধের অভাবে প্রান্তিক রোগীরা বিপাকে পড়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, অনেক সময় এসব কেন্দ্র পুরোপুরি জনশূন্য থাকে। মাঝে মাঝে কোনো পরিদর্শিকাকে দেখা গেলেও তারা শুধু উপস্থিতি স্বাক্ষর দিয়ে চলে যান। যারা কাজ করেন তারাও নাকি গত বছরের জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। ফলে একদিকে ওষুধপত্র ও বেতন ভাতাবিহীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো দিনের অধিকাংশ সময় ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়।
কুড়িগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ৭৮৬টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৫৬৯ জন। শূন্যপদের মধ্যে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ৮৬টি পদের মধ্যে ৭৫ জন কর্মরত, পরিবার কল্যাণ সহকারী ৩৯৬ জনের বিপরীতে ২৭৫, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ৩৭ জনের মধ্যে ১৮ জন, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ৯ জনের বিপরীতে ৩ জন। উপজেলা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ৯ জনের বিপরীতে ৩ জন। মেডিকেল কর্মকর্তা ১৭ জনের বিপরীতে ৪ জন কর্মরত রয়েছেন। আয়া পদের জন্য ৩৯টি শূন্যপদ থাকলেও পাওয়া গেছে ১৯ জনকে। কিন্তু সেটিও কর্তৃপক্ষের নিয়োগ সিদ্ধান্ত না হওয়ায় কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। ফলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে নরমাল ডেলিভারিসহ এফডব্লিউসি কার্যক্রম ব্যহত হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও জনবল সংকটের এ ঘাটতির কারণে জেলার লাখো দরিদ্র জনগোষ্ঠী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন এটি আগে উন্নয়ন খাতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বরাদ্দে পরিচালিত হতো। এখন তা বাতিল করে রাজস্ব খাত হতে নতুন করে দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এখনো সেই প্রকল্প চালু করা হয়নি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মোছাঃ লুৎফা বেগম রিকতা বলেন, আগে প্রতি মাসেই নরমাল ডেলিভারি হতো। এখন ওষুধ না থাকায় রোগী কম আসছে। কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত ২৭টি ওষুধের একটিও নেই। এখন আমরা শুধু গর্ভবতী মায়েদের প্রেসার চেক করা ও ওজন মেপে স্বাস্থ্য পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে না পেরে আমরা নিজেরাও অসহায় বোধ করছি।
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবী মোছাঃ হাছিনা খাতুন বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের পর আমরা ১৭ জন নারী স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু গত এক বছর থেকে আমাদের বেতন ভাতা বন্ধ। একদিকে বেতনভাতা বন্ধ অন্য দিকে প্রতিদিন ফিল্ডে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি।
কুড়িগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক মোঃ মোদাব্বের হোসেন বলেন, জনবল সংকট এবং ওষুধ না থাকায় সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে সরকার একটি দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সেটি বাস্তবায়িত হলে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। চলচিত্র প্রদর্শনী ও উদ্বুদ্ধকরণ গাড়ির তেল বাবদ ডিপোতে ৩ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ৭০ হাজার টাকা দিতো সেটিও বন্ধ, আনসার সদস্য ১৮ জন ও স্বেচ্ছাসেবকদের বেতন এক বছর ধরে বন্ধ। কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ ও জনবল সংকটে জেলার প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে আমাদের আন্তরিকতার কমতি নেই। যথাযথ সেবা দেওয়ার জন্য আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি।