মুসলিম জীবনে শরিয়াহ আইন কেন গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশকালঃ ২৪ মে ২০২৩ ১২:০৬ অপরাহ্ণ ৮৭ বার পঠিত
মুসলিম জীবনে শরিয়াহ আইন কেন গুরুত্বপূর্ণ

কোরআন-হাদিসের টেক্সটগুলো সাধারণত দুই ধরনের পাঠসংবলিত। প্রথম প্রকারের টেক্সটগুলো হলো: যাতে উপদেশাবলি যথা : দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও আখিরাতের স্থায়িত্ব, কেয়ামত ও হাশর-নশর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও সতর্কীকরণ, ঘটনাবলি ও আল্লাহর গুণ-কীর্তন ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রকার হলো, বিধানসংক্রান্ত যথা: তাহারাত, নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ, জিহাদ, দণ্ডবিধি, লেনদেন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকার বণ্টননীতি ইত্যাদি। প্রথম প্রকারের টেক্সটগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের উপদেশ গ্রহণের জন্য কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি।

কেউ আছ কি যে (তা থেকে) উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সুরা কমার : আয়াত ১৭, ২২, ৩২, ৪০)

আয়াতে উল্লিখিত ‘উপদেশ গ্রহণের জন্য’ এ অংশটি সুস্পষ্ট প্রমাণ করে যে উপদেশ সম্পর্কিত আয়াতসমূহই সর্বসাধারণের বোধগম্য বিষয়, অর্থাৎ এ বিষয়গুলোই পরিমিত জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাও নিজেদের সাধারণ বোধ-বুদ্ধির মাধ্যমে বোঝা ও আত্মস্থ করা সহজ।

তবে দ্বিতীয় প্রকারের টেক্সটসমূহের সম্বোধিত ব্যক্তি জনসাধারণ নন; বরং মুজতাহিদ তথা গভীর জ্ঞানের অধিকারীগণ, যাঁরা আল্লাহপ্রদত্ত গভীর জ্ঞান, উপলব্ধি ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কঠিন ও সূক্ষ্ম মাসআলাসমূহের সমাধান করেন। কোন আয়াত বা হাদিস রহিত আর কোনটা আমলযোগ্য, বর্ণনাসমূহের বাহ্যিক বিরোধের কারণসমূহ ও সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ত্রুটিসমূহের পরিচিতি, পূর্বাপরের সঙ্গে মিল-অমিল, আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট, হাদিসসমূহের প্রেক্ষাপট এবং ফিকাহশাস্ত্রের মূলনীতিসমূহের মাধ্যমে টেক্সটসমূহের বাহ্যবিরোধের সমাধান ও ব্যাখ্যাকরণসহ যাবতীয় জ্ঞান রাখেন।

তদ্রুপ কোরআন-সুন্নাহে কোনো সমাধান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে সম-হেতুর ভিত্তিতে এ জাতীয় অন্য টেক্সটের আলোকে কিয়াসের মাধ্যমে তা সমাধানে পারদর্শী। কোরআন-হাদিসের পাঠে অনেক ক্ষেত্রে একটি শব্দের একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তখন শক্তিশালী প্রমাণের মাধ্যমে এর অর্থ নির্ধারণে সক্ষম। এসব কর্মসাধনকে ‘ফিকহ’ ও ‘ইজতিহাদ’ বলা হয় এবং এর বাহককে বলা হয় ‘ফকিহ’ ও ‘মুজতাহিদ’।


ফিকাহশাস্ত্রের গুরুত্ব

ফিকাহশাস্ত্রের গুরুত্ব এ থেকে অনুমান করা যায় যে এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা ফিকাহ অর্জনের উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী দল গঠনকে অনিবার্য ঘোষণা করেছেন, ‘আর মুমিনদের সবাই (সর্বদা) একত্রে (জিহাদের জন্য) বের হয়ে যাওয়া উচিত নয়।

সুতরাং এমন কেন হয় না যে তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি ছোট দল (জিহাদে) বের হবে, যাতে (যারা জিহাদে যায়নি) তারা দ্বিনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন (জিহাদ থেকে) তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে তখন তাদের সতর্ক করবে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২২)

আয়াতটির উদ্দেশ্য এই যে দ্বিনের দুটি মৌলিক চাহিদা আছে : একটি হলো দ্বিনের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়, আর অন্যটি হলো দ্বিনের সঠিক বুঝ ও গভীর জ্ঞান। আর এটি বলাই বাহুল্য যে দ্বিনের প্রতিষ্ঠা নির্ভরশীল হলো দ্বিনের সঠিক বুঝ ও উপলব্ধির ওপর। তাই আল্লাহ তাআলা তাগিদ দিয়েছেন যেন একটি দল দ্বিনের বিজয় ও আধিপত্য অর্জনের উদ্দেশ্যে জিহাদে বের হয়, আর অপর দল যেন কোরআন-সুন্নাহের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য স্বীয় স্থানে অবস্থান করে মেহনত করে, যাতে দ্বিনের উভয় শাখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে।


ফকিহগণের অবস্থান ও মর্যাদা

ফিকাহশাস্ত্রের অতীব প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সৌভাগ্যশীল মানুষ তাদের জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো এই প্রিয় শাস্ত্রের জন্য উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের অনেক ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি যাকে চান হিকমত তথা প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে হিকমত দেওয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেওয়া হয়। আর বিবেকসম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৯)

উক্ত আয়াতে হিকমতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের অধিকাংশের মতামত হলো এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফিকাহ তথা দ্বিনের সঠিক বুঝ। যেন আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি সমুদয় কল্যাণ ও গুণাবলিকে সবচেয়ে বেশি ধারণ করতে পেরেছে সে হলো ফকিহ। (তাফসিরে ইবনে কাসির ১/৭০০)

মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তিনি তাকে দ্বিনের সঠিক উপলব্ধি ও গভীর জ্ঞান দান করেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৭১)

এ ছাড়া হাদিসের কিতাবসমূহে ফকিহদের ফজিলত সম্পর্কীয় শত শত হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে।


হাদিসবিশারদদের দৃষ্টিতে ফিকাহশাস্ত্র ও ফকিহগণের অবস্থান

মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.) বলেন, ‘তোমরা {আবু হানিফা (রহ.)-এর ফতওয়াসমূহকে} আবু হানিফা (রহ.)-এর রায় বা সিদ্ধান্ত বলো না; বরং বলো যে এগুলো তো হাদিসের ব্যাখ্যা।’ (জাওয়াহিরুল মুজিআ, মোল্লা আলী কারি-এর পরিশিষ্ট : ১/৪৬০)

মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) বলেন, ‘হাদিস পাঠ (অনেকের জন্য) ভ্রষ্টতার কারণ হতে পারে। তবে ফোকাহায়ে কেরাম এর ব্যতিক্রম।’ (খুতবাতুল কিতাব, আবু শামা মাকদেসি পৃষ্ঠা ১৫১) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, না বুঝে হাদিস পাঠ করার কারণে অনেকেই ভ্রান্তিতে পতিত হতে পারে। তবে ফকিহগণ যেহেতু হাদিসের সঠিক মর্মোদ্ধারে অগ্রগণ্য, তাই তাদের জন্য ভ্রান্তির কারণ হয় না।

ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, ‘ফিকাহ হলো হাদিসের ফলাফল বা ফসল।’ (তাহজিবুল কামাল ২৪/৪৬৪)

ইমাম তিরমিজি (রহ.) লিখেন : ‘ফকিহরাই হাদিসের সঠিক মর্মোদ্ধারে অধিক জ্ঞান রাখে।’ (সুনানে তিরমিজি ৩/৩০৬)

প্রসিদ্ধ হাদিসবিশারদ ইমাম আমাশ (রহ.) বলেন, ‘হে ফকিহরা, তোমরাই হলে ডাক্তার, আর আমরা কেবল ফার্মাসিস্ট।’ (কিতাবুস সিকাত ইবনে হিব্বান : ৮/৪৬৭)

ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন, ‘উম্মতের ফকিহগণ যা কিছু বলেছেন সেগুলো হলো সুন্নাহর ব্যাখ্যা, আর বর্ণিত সব সুন্নাহ হলো কোরআনের ব্যাখ্যা।’ (আলইতকান, সুয়ুতি ৪/২৮)


একটি ভুল বোঝাবুঝির নিরসন

ফিকাহশাস্ত্র আপাতদৃষ্টিতে কোরআন ও হাদিস থেকে পৃথক একটি তৃতীয় বিষয় মনে হয়। বরং ফিকাহশাস্ত্র অস্বীকারকারীদের মতে তো তা একটি স্বতন্ত্র মতবাদের নাম, যা তাদের ধারণামতে শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু বাস্তব কথা হলো, ফিকাহশাস্ত্র হলো শরিয়া আইনের একটি সরলীকৃত দলিল-দস্তাবেজ ও সংকলিত নথি। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকাহ সংকলনের ক্ষেত্রে একক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। বরং তিনি এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি মজলিসে শুরা গঠন করেন যুগশ্রেষ্ঠ ৪০ জন আলেমকে নিয়ে, যাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন মুজতাহিদ। যেকোনো কঠিন ও জটিল বিষয়ের শরয়ি সমাধান বের করার জন্য যতটুকু যোগ্যতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তার সবই ছিল তাঁদের মধ্যে শতভাগ বিদ্যমান।

এ ছাড়া কেউ কেউ ছিলেন বিশেষ বিশেষ জ্ঞানের শাখায় পণ্ডিত, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বিচক্ষণ। যখন কোনো জটিল মাসআলা পেশ হতো, তখন ইমাম আবু হানিফা (রহ.) শুরার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা এবং মতবিনিময় করতেন। প্রথমে এ বিষয়ে তাঁদের জানা সুন্নত ও আ-সারে সাহাবা উপস্থাপন করতে বলতেন, এরপর নিজের জ্ঞানভাণ্ডারে যা থাকত, তাও পেশ করতেন। অতঃপর চূড়ান্তভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কখনো এক মাস বা ততোধিক সময়ও আলোচনা-পর্যালোচনা ও মতবিনিময়ের ধারা অব্যাহত থাকত। (জামেউল মাসানিদিল ইমাম : ১/৩৩)

এভাবেই তিনি খোদাভীরু-যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের সমন্বয়ে ইসলামী জীবনব্যবস্থার আইনি ধারা প্রণয়ন এবং শরিয়া মূলনীতি ও শাখাগত বিষয়াদির নকশা তৈরি করেন, যা সর্বদিক দিয়ে শোধিত, মার্জিত, সুবিন্যস্ত এবং মানবজীবনের সর্বদিক নিয়ে ব্যাপৃত।


সারকথা

এক কথায় ফিকাহ হলো, আল্লাহপ্রদত্ত বিধানসমূহের সুবিন্যস্ত রূপ। এটি কোনো ফকিহের নিজস্ব মনগড়া মতামত নয়। তাঁদের নিজেদের মনগড়া মতামত প্রদানের কোনো অনুমতি নেই; বরং তাঁরা তো কেবল কোরআন-হাদিসে সুপ্ত আইনসমূহকে উম্মতের সামনে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেছেন। মাসায়েল ও ফতওয়াগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ফকিহ আবু হানিফা বা মালেক বা শাফেঈ রহিমাহুমুল্লাহ-এর দিকে সাধারণত এ জন্যই সম্বন্ধ করা হয় যে তাঁরা সেগুলো প্রকাশ ও উদঘাটন করেছেন, এ জন্য নয় যে এগুলো তাঁদের বানানো মতামত।