আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকারের বেশি ব্যাংকঋণ মূল্যস্ফীতি বাড়ায়।
বাজেটের অর্থের জোগান পেতে সরকার আগের চেয়ে বেশি ব্যাংকমুখী হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ চলতি বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি বাড়বে।
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র হচ্ছে, ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে তার প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। কারণ, ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার টাকা ছাপিয়ে মেটায়। টাকা ছাপালে তখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
আগামী অর্থবছরে ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করে যোগাযোগ করলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে, পুরো অর্থবছরে তা নেওয়া হলে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, টাকাগুলো উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করাই সরকারের উদ্দেশ্য।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করতেই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়। দেশের মধ্যে ব্যাংক–ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রই ঋণের হচ্ছে প্রধান উৎস। আর বিদেশ থেকে ঋণের ক্ষেত্রে উৎস হচ্ছে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। আগামী অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে সরকার ১ লাখ ২০০০ কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার চিন্তা করছে, চলতি অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
প্রতিবারই অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়া বাড়ে। বিশেষ করে জুন মাসে। চলতি অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে সূত্রগুলো জানায়। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। আগের অর্থবছরে ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। একই সময়ে চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৩৯ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৭৮ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ৬৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। দেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণ বাড়লেও কমে গেছে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি প্রায় নেতিবাচক। অথচ চলতি অর্থবছরে সরকার ধরে নিয়েছিল, এ খাত থেকে নিট ৩৫ হাজার কোটি টাকা আসবে। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে তারপরও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাবে বলে আশা করছে।
নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির নেতিবাচক চিত্রের কারণে জুন শেষে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চিত্র ৪ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক। অর্থাৎ এ সময়ে সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে বরং সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে মানুষ টাকা তুলে নিয়েছেন বেশি।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া দুই কারণে খারাপ। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে, যার ভুক্তভোগী হন ভোক্তারা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ।
দেশে মূল্যস্ফীতির হার গত এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থবছর শুরুর দুই মাসের মাথায় গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি যেখানে গিয়ে ঠেকুক না কেন, অর্থের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংকঋণের কোনো বিকল্প আগেও ছিল না, চলতি অর্থবছরেও নেই, আগামী অর্থবছরেও থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী কী বলেছেন জানি না। তবে এটা তো ঠিক যে বেশি ব্যাংকঋণ মানেই বেশি টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। শুধু তাই নয়, এতে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থান ব্যবস্থা।