প্রকাশকালঃ
১৫ মার্চ ২০২৩ ০৪:০০ অপরাহ্ণ ৩৬০ বার পঠিত
পর্দা নামল দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ আয়োজন বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলনের। তিন দিনের এ আয়োজন গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ১২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান ও সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে।
সম্মেলনের শেষ দিনে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এ সম্মেলন দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। এরই মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে চারটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। সৌদি আরব থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসবে বলেও আশার কথা জানান জসিম উদ্দিন।
ব্যবসা সম্মেলনে ৫৬ জন সৌদি প্রতিনিধি অংশ নেন। সব মিলিয়ে এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ৩০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের মোট আটজন মন্ত্রী অংশ নেন এ সম্মেলনে।
এফবিসিসিআই জানিয়েছে, সংগঠনটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সক্ষমতা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গত শনিবার সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে গতকাল সম্মেলনের সমাপনী দিনে ওষুধশিল্প, গাড়িশিল্প, পর্যটনশিল্পসহ নানা খাতের বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে মোট আটটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এসব অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনার দিক তুলে ধরেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। গত দুই দিনের আলোচনায় অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি, পোশাক, ওষুধ, গাড়ি, কৃষি ও পর্যটনশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ১০ হাজার কোটি ডলার বা ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়। তবে বিনিয়োগ আনতে হলে সরকারি সেবা সহজ করতে হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ওষুধ খাত নিয়ে অনুষ্ঠিত দিনের এক অধিবেশনে বলা হয়, বৈশ্বিক ওষুধের বাজারের ১০ শতাংশ হিস্যার ভাগীদার হওয়ার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে ওষুধ উৎপাদনে ভারতকে বলা হয় বিশ্বের ফার্মেসি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন ওষুধের জন্য ভারতের বাইরে নতুন দেশ অর্থাৎ ভারত প্লাস খুঁজছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ হতে পারে ওষুধ উৎপাদনে বড় ধরনের সম্ভাবনাময় দেশ। কারণ, এ দেশে আছে সস্তা শ্রম, যা চীন ও ভারত কারোরই নেই।
‘বাংলাদেশে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা: প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক সংযুক্তি ও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিনিয়োগের সুযোগ’ শীর্ষক এ অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি আবদুল মুক্তাদির।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খানের সঞ্চালনায় অধিবেশনে আলোচক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ও গ্রিন লাইফ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শাহলা খাতুন, মেড্রোনিকসের কান্ট্রি হেড দেবজ্যোতি ব্যানার্জি ও সিনোভেদা কানাডার প্রেসিডেন্ট ইউয়ান কে টাম।
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে অল্প খরচে উন্নত মানের ওষুধ তৈরি হয়। দেশের বাজারে প্রথম থেকে দশম অবস্থানে থাকা কোম্পানির হাতেই দেশের ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশের হিস্যা রয়েছে। তবে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলোর হিস্যাই ৫২ শতাংশ। দেশের ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের ১৫৭টি দেশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। দেশের ২৬৫টি নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ২১৩টিই উৎপাদনে রয়েছে।
অধিবেশনে আরও বলা হয়, দেশের মোট ওষুধ চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ হয় দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে। বাকি ৩ শতাংশ আমদানি করতে হয়। ২০২২ সালে এ খাতের বাজারটি ছিল ৩৩২ কোটি ডলারের। ২০২৭ সালে এ বাজারের আকার বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬৬৮ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
অনুষ্ঠানে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি আবদুল মুক্তাদির বলেন, "ওষুধের বৈশ্বিক বাজার ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। যদি আমরা বৈশ্বিক বাজার চাহিদার ১ শতাংশও রপ্তানি করতে পারি তবে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় আসবে ৪০০ কোটি ডলার। চীনের ওষুধের বাজার ২২ হাজার কোটি ডলারের। আর ভারতের বাজার চার হাজার কোটি ডলারের। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এ দুই দেশের পক্ষে বৈশ্বিক চাহিদা মেটানো সহজ নয়।"
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য উল্লেখ করে অধিবেশনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যয় বাবদ বাংলাদেশ থেকে বছরে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায়। এ বিষয়ে মেড্রোনিকসের কান্ট্রি হেড দেবজ্যোতি ব্যানার্জি বলেন, বাংলাদেশেই উন্নত মানের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় করছেন বাংলাদেশিরা, তার কোনো দরকার নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাজমুল হাসান বলেন, গত কয়েক বছরে চীনে ওষুধ খাতের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বেতন-মজুরি ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। বেতন ও মজুরি বৃদ্ধিতে ভারতও উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সস্তা শ্রম রয়েছে। তাই সস্তায় উন্নত মানের ওষুধ তৈরির অন্যতম বৈশ্বিক কেন্দ্র হওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যবসা সম্মেলনের আরেকটি অধিবেশন ছিল ‘সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব: বেসরকারি খাতের ভূমিকা এবং বিনিয়োগ সুযোগ’ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১ মো. নাফিউল হাসানের সঞ্চালনায় এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের সিইও মো. মুশফিকুর রহমান ছিলেন সভাপতি। আর নির্ধারিত আলোচক ছিলেন মেট্রো চেম্বারের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির, ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের সিইও মো. শফিকুল ইসলাম আকন্দ, বাংলাদেশে পিডব্লিউসির ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশিদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জং কিউন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালক তাকিও কোইকি এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক আবুল বাশার।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বলেন, জমি অধিগ্রহণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ব্যাংকঋণ তিনটি হচ্ছে পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা। ব্যাংকঋণের ভালো বিকল্প হতে পারে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ। পিপিপি প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার পাশাপাশি প্রকল্প থেকে মুনাফা আসবে কি না, তাও যাচাই করা উচিত।
ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের সিইও শফিকুল ইসলাম আকন্দ বলেন, দেশে পিপিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। দেখা গেছে, অর্থ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তা মানছে না। আর জমি অধিগ্রহণ করতেই বেশি সময় লেগে যায়। অন্তত ৮০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের পর পিপিপি চুক্তি করা উচিত।
নিহাদ কবির বলেন, পিপিপি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের জন্য নিয়মকানুন সহজ করতে হবে।
এ অধিবেশনের মুক্ত আলোচনায় প্রশ্ন ছিল পিপিপির প্রতি বেসরকারি খাত আকৃষ্ট হচ্ছে না কেন। জবাবে পিপিপি কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক আবুল বাশার বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি। অন্তত রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই এ ব্যাপারে।"