আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদে যাত্রীবাহী নৌকায় ডাকাতির সময় ঘটনাস্থলে থাকা চিলমারী থানার এক সহকারী উপপরিদর্শকসহ (এএসআই) তিন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে রাখেন ভুক্তভোগী নৌযাত্রীসহ স্থানীয় জনতা। ঘটনাস্থলের কাছে থেকেও যাত্রীদের সহায়তায় এগিয়ে না আসার অভিযোগে তাদের অবরুদ্ধ করা হয়।
পরে চিলমারী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করেন।
তবে পুলিশ এ ঘটনাকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ দাবি করেছে। ঘটনাস্থলের একেবারে কাছে থেকেও ডাকাতির হাত থেকে যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে না যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও এ জন্য নৌকার শ্যালোইঞ্জিন স্টার্ট না নেওয়াকে দায়ী করেছে পুলিশ। যদিও স্থানীয়দের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি এএসআই জাহাঙ্গীর দুলাল। অপর দুই জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তারা তিন জনই চিলমারী মডেল থানায় সংযুক্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের কড়াইবরিশাল খেয়াঘাট-সংলগ্ন স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদে দুটি যাত্রীবাহী নৌকায় আক্রমণ করে ১৫-১৬ জনের সশস্ত্র ডাকাতদল। নৌকার মাঝি, নৌকায় থাকা গরু ব্যবসায়ী ও যাত্রীদের মারধর করে কয়েক লাখ টাকা লুটে নিয়ে যায় তারা। এ সময় খেয়াঘাটের কাছে পোশাক পরিহিত ও সশস্ত্র তিন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও তারা এগিয়ে আসেননি। স্থানীয় লোকজন নৌকা নিয়ে ডাকাতদের ধাওয়া করলেও ওই তিন পুলিশ সদস্য নির্বিকার ছিলেন বলে অভিযোগ যাত্রী ও স্থানীয়দের। ঘটনার পরপরই জনরোষে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন তারা। নারী ও পুরুষ সকলের তোপের মুখে পড়েন ওই তিন পুলিশ সদস্য।
চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আল আমিন বলেন, ‘জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য যে পুলিশ সেই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল। কিন্তু যাত্রীদের উদ্ধার কিংবা ডাকাতদের ধরতে তারা এগিয়ে যাননি। তাদের সামনে ডাকাতরা লুটে নিয়ে চলে যায়। এ জন্য স্থানীয় লোকজনের তোপের মুখে পড়েন তিন পুলিশ সদস্য। এক পুলিশ সদস্য দায় না নিয়ে উল্টো স্থানীয়দের ওপর উত্তেজিত হন। ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। জনরোষ থেকে বাঁচাতে তাদের ইউনিয়ন পরিষদে নেওয়া হয়। সেখানে এক ঘণ্টারও বেশি সময় রাখা হয়। পর ওসি সাহেব এসে ঘটনার তদন্তের আশ্বাস দিয়ে তাদের নিয়ে যান।’ এ সময় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নৌকার মাঝি মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘খেয়াঘাটের কাছে দুইটা নৌকায় ডাকাতি হইছে। ১০-১৫ জন ডাকাত ছিল। তারা একটা গুলি ছোড়ে। এরপর ডাকাতি করে চলে যায়। পাশেই পোশাক পরা তিন জন পুলিশ ছিল। কিন্তু তারা আগায় আসে নাই।’
কড়াইবরিশাল এলাকার বাসিন্দা আজম মিয়া বলেন, ‘ঘাটের কাছেই পুলিশ ছিল। গুলির শব্দ ও যাত্রীদের চিৎকারে ঘাটের কাছে থাকা স্থানীয় লোকজন এগিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ আগায় আসে নাই। পরে আমরা নৌকা নিয়ে ডাকাতদের ধাওয়া করি। কিন্তু ডাকাতরা পালিয়ে যায়।’
ভুক্তভোগী গরু ব্যবসায়ীদের বরাতে আজম মিয়া বলেন, ‘ব্যাপারীদের কয়েক লাখ টাকা ডাকাতরা নিয়া গেছে। পুলিশ একটা ফাঁকা গুলি করলেও ডাকাতদের ধরা যাইতো। কিন্তু তারা আগায় আসে নাই।’
ডাকাতির ঘটনার পরপর কড়াইবরিশাল এলাকার বাসিন্দারাসহ ভুক্তভোগী যাত্রীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত তিন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করেন। পুলিশের নীরব ভূমিকায় সন্দেহ প্রকাশ করে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা ডাকাতির ঘটনায় পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ তোলেন। জনরোষে পড়ে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আশ্রয় নেন ওই তিন পুলিশ সদস্য। সেখানেও স্থানীয়রা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন।
চিলমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোসাহেদ খান বলেন, ‘ঠিক অবরুদ্ধ নয়। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।’
ঘটনাস্থলে থাকার পরও যাত্রীদের সহায়তায় এগিয়ে না যাওয়া প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘তারা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়নি। নদীতে টহলের দায়িত্ব মূলত নৌপুলিশের। তারপরও নিরাপত্তার জন্য আমি বাড়তি পুলিশ টহলে নিযুক্ত করেছি। তাদের কোনও গাফিলতি থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে ডাকাতির ঘটনায় মামলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিলমারী নৌপুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) খলিল। তিনি বলেন, ‘মামলার এজাহার দেওয়ার জন্য কয়েকজন যাত্রী ফাঁড়িতে এসেছেন। তারা এজাহার দিলে মামলা নথিভুক্ত করা হবে।’
এর আগে, গত ২৯ জানুয়ারি কড়াইবরিশাল এলাকার পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদে যাত্রীবাহী নৌকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তারও আগে গত বছর ২১ ডিসেম্বর চিলমারীর অষ্টমীরচর ইউনিয়নের দুইশ বিঘার চরের কাছে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১৬-১৭ জনের ডাকাতদল পিস্তল ও দেশি অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চলে যায়। দিনদুপুরে একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় এই নৌপথ যাত্রা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।