গায়েবানা জানাজায় পুলিশের বাধা, ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ১৬ জুলাই ২০২৫ ০১:১২ অপরাহ্ণ   |   ৩৪ বার পঠিত
গায়েবানা জানাজায় পুলিশের বাধা, ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা

ঢাকা, ১৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস): চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় বাধা দেয় পুলিশ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জানাজা, কফিন মিছিল, বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পালিত হয় দিনটি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সারাদেশে সর্বাত্মক ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
 

পবিত্র আশুরার ছুটির দিন ১৭ জুলাই সকাল থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত। আন্দোলনকারীরা ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দিয়ে ক্যাম্পাসকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল খালি করতে নির্দেশ দেয়। সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখতে মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশ দেয়।
 

রাজধানী ঢাকায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাজলা টোলপ্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। শনিরআখড়া থেকে কাজলা পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। দিনভর চলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
 

এর আগে ১৬ জুলাই ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ ছয়জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে দুজন ঢাকা সায়েন্সল্যাব এলাকায় ও চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামসহ তিনজন ছিলেন।
 

নিহতদের স্মরণে ১৭ জুলাই রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে জানাজা শুরুর আগেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে। বিকেল চারটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে পুনরায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে শিক্ষার্থীরা প্রতীকী কফিন হাতে শপথ নেন—দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার।
 

জানাজা শেষে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে টিএসসি অভিমুখে যাত্রার চেষ্টা করলে পুলিশ ফের বাধা দেয় এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন।
 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম অভিযোগ করেন, “পুলিশ ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশপথে শিক্ষার্থীদের আটকেছে, টিয়ার গ্যাস, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডে ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।”
 

এদিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গায়েবানা জানাজায় বাধা দেয় পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা। কোথাও কোথাও হামলার ঘটনাও ঘটে।
 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। তবে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এই নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে রাতেও হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করে।
 

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, “পুলিশ হল খালি করার অনুমতি পেয়েছে, সময়মতো না ছাড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
 

১৬ জুলাই রাতভর আন্দোলনকারীরা আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর করেন এবং ১৪টি হলে ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ সংক্রান্ত অঙ্গীকারনামায় প্রাধ্যক্ষদের স্বাক্ষর আদায় করেন।
 

এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও হত্যার প্রতিবাদে এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র আন্দোলন। জরুরি সেবা ব্যতীত সবকিছু বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়।
 

রাত ৮টায় ফেসবুক লাইভে আন্দোলনের অন্যতম নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “এই কর্মসূচি সফল করতে দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে।”
 

এদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরুন। আমি বিশ্বাস করি ছাত্রসমাজ ন্যায়বিচার পাবে, হতাশ হবে না।”
 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “এই আন্দোলন স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে চলে গেছে, বসে থাকার সময় নেই।” আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত এসেছে, সবাই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত থাকুন।”
 

১৭ জুলাই শহীদ আবু সাঈদকে রংপুরের পীরগঞ্জে তার নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। সকাল সোয়া ৯টায় জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে সাড়ে ১০টায় দাফন সম্পন্ন হয়।
 

একই দিন বিকেলে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। পুলিশ সেখানে বাধা দেয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সরকার চাইলে আলোচনার মাধ্যমে কোটা সমস্যার সমাধান করতে পারত, কিন্তু বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডকে বেছে নিয়েছে।”
 

চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি ময়দানেও হাজারো ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া দেশের অন্তত ১০টি সড়ক-মহাসড়ক ও দুটি রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেন।

সূত্র: বাসস।