চীনের প্রভাব ঠেকাতে এককাট্টা জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া

প্রকাশকালঃ ২০ মার্চ ২০২৩ ০৪:২৫ অপরাহ্ণ ৩২২ বার পঠিত
চীনের প্রভাব ঠেকাতে এককাট্টা জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান শত বছরের পুরোনো তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে নতুন সম্পর্ক গড়তে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগরে উপকূলে অবস্থিত দেশ দুটি এমন এক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে যে, নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিরোধ দূর করা ছাড়া তাদের সামনে তেমন  কোনো বিকল্পও নেই। কারণ, এই দুটি দেশের জন্য দিনে দিনে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উদীয়মান পরাশক্তি চীন ও উত্তর কোরিয়া।

সম্পর্ক স্থাপন দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। কারণ এ দুটি দেশের রয়েছে অতীতের তিক্ত ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া ছিল জাপানের উপনিবেশ। এই ৩৫টি বছর জাপানিরা দুর্বিষহ নির্যাতন করেছে কোরিয়ানদের ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান সাড়ে ৭ লাখ  কোরিয়ানকে জোর করে দাস হিসেবে খাটিয়েছে, ২ লাখ নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করেছে, এদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে বন্দিশালায়, অনেকে সারা জীবনের জন্য হয়েছে পঙ্গু। অসংখ্য কোরিয়ান হত্যার শিকার হয়েছে। ১৯১৯ সালে শুধু এক দিনেই  জাপানের পুলিশ সাড়ে ৭ হাজার কোরিয়ান বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।  কোরিয়ান নাগরিকরা তীব্র ঘৃণা পোষণ করে থাকে জাপানিদের কর্মকাণ্ডের জন্য। তাই দুই দেশের সম্পর্ক তেমন একটি সামনে এগোয়নি। 

যদিও অতীত অপকর্মের জন্য জাপানের বিভিন্ন সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে ভালো জবাব আসেনি। দেশটি নির্যাতনের শিকার নাগরিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছিল জাপানের কাছে। 

এমন প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে ১২ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওল জাপান সফর করেছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা যখন আলোচনা করছিলেন, তার কিছুক্ষণ আগে উত্তর কোরিয়া ফের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার জলসীমার দিকে। এটি ছিল এক সপ্তাহের মধ্যে চতুর্থ বারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

দুই শীর্ষ নেতা সম্মত হয়েছেন পুনরায় ভ্রমণ স্বাভাবিক করার, দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের অবসানের। জাপান রাজি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায় সেমিকন্ডাক্টরের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া  বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় জাপানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জানিয়েছিল, তা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা আগামী মে মাসে হিরোশিমাতে অনুষ্ঠেয় জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে পারেন ইয়ুনকে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সামরিক নিরাপত্তা বিনিময় চুক্তি কার্যকর করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৬ সালে করা ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এই চুক্তির আওতায় দেশদুটি সামরিক গোপন তথ্য বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সামর্থ্যের ব্যাপারে তথ্য আদান-প্রদান করবে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওল রাজনীতিতে নতুন। নেই বৈদেশিক কূটনীতির অভিজ্ঞতা। তবুও তিনি বহু বছরের পুরোনো ঘায়ে উপশম দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ইয়ুন জাপানের দাসত্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জাপানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে নিয়েছেন। উলটো তিনি বলেছেন, কোরিয়া সরকার নিজেরাই তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করবে। এতকিছুর বিনিময়ে তিনি ইতিহাসের কালো অংশটুকু সচেতনভাবে একপাশে রেখে উত্তরপূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা রক্ষা করতে চাচ্ছেন। কারণ এ অঞ্চলে চীন একক আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। চীনের এ ধরনের বিস্তার দক্ষিণ চীন সাগর উপকূলের অন্যান্য দেশগুলোকে স্বস্তি দিচ্ছে না। কূটনীতিকরা ইয়ুনের এই ধরনের অকল্পনীয় চালে বিস্মিত ও মুগ্ধ। তাদের মতে, ইয়ুন মাত্র বছরখানেক আগেও আইনজীবী থাকলে কী হবে, বাস্তবতা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তার এই পদক্ষেপ সাহসী ও বিচক্ষণ।

ঐ অঞ্চলে উত্তর কোরিয়াও ক্রমে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এমন প্রেক্ষাপটে সিওল নিরাপত্তা তথ্য বিনিময় করবে জাপানের সঙ্গে। দুই দেশের সামরিক বাহিনী একত্রে সামনের দিনগুলোতে চীন ও উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলা করবে। উত্তর কোরিয়া দিনে দিনে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে বেশ এগুচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশটি পারমাণবিক বোমা তৈরির পথেও হাঁটছে। 

সিউলের এ পদক্ষেপে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকাও সন্তুষ্ট। চীনের উত্থানে উদ্বিগ্ন আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলোকে একত্রিত করে চীনকে ঠেকাতে চাচ্ছে। জাপানও ওয়াশিংটনকে পুনঃনিশ্চয়তা দিয়েছে যে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ও অস্থিতিশীল এ অঞ্চলে শক্তি হ্রাসের ক্ষমতাসম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র আমেরিকার ওপর এখনো নির্ভরশীল। প্রেসিডেন্ট ইয়ুন উত্তর কোরিয়ার ওপর শুধুমাত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তিনি বাহ্যিক দিকে অর্থাৎ ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলেও দৃষ্টিপাত করে, দক্ষিণ কোরিয়া যে এ অঞ্চলে বড় শক্তি তা প্রমাণ করতে চান।

ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র দেশ নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে এনেছে, এতে এই অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকার শক্তির ভিত্তি আরো মজবুত হয়েছে।