আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-
নয় বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন সালেমা বেগম। অভাবের মধ্যে থেকে বড় মেয়ের বিয়ে দিলেও অপর দুই মেয়ের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামীর মৃত্যু সালেমাকে যেন দিশাহারা করে দিয়েছে। দিনমজুরের কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালালেও তাতে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না গ্রামীণ এই নারী।
পেশায় দিনমজুর সালেমা বেগমের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের তনুরাম গ্রামে। দশম ও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংসার।
অভাব আর অসহায়ত্বে ভরা সালেমার জীবন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা প্রায়ই পরামর্শ দেন দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেজো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ভার কমানোর। কিন্তু সালেমার ইচ্ছা মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে স্বাবলম্বী করবেন। এজন্য বাড়তি রোজগার করতে চান সালেমা। কিন্তু উপায়?
সালেমার কিশোরী মেয়ের বিয়ে ঝুঁকির খবরে তার পাশে দাঁড়িয়েছে আরডিআরএস নামক বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটির চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের আওতায় ‘দ্রুত আয় বৃদ্ধিমূলক’ এবং ‘ব্যবসা শুরু ও উন্নয়ন’ বিষয়ক প্রশিক্ষণে সালেমাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে সংস্থাটি। প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সালেমা স্বপ্ন দেখছেন বাড়তি আয় করে স্বাবলম্বী হবেন। মেয়েদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করবেন। একদিন তার মেয়েরা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
শুধু সালেমা নন, তার মতো উপজেলার ৫ ইউনিয়নের ৩০ জন নারী-পুরুষ এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। যাদের প্রত্যেকের পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরী মেয়ে রয়েছে। চার দিনব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে তারা জানতে পেরেছেন কীভাবে সংসারে দ্রুত আয় বৃদ্ধি করা যায়। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ছিল প্রশিক্ষণের শেষ দিন। উলিপুরের দুর্গাপুর ইউনিয়ন ফেডারেশনে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গিয়ে কথা হয় সালেমা বেগমসহ অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে। পরিবারের বাড়তি আয়ে এই প্রশিক্ষণ সহায়ক হবে বলে মন্তব্য সবার।
প্রশিক্ষণে কী জানলেন তারা:
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ ও সিএনবি প্রকল্প সংশ্লিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ৩০টি দরিদ্র পরিবারের ১৮ জন নারী ও ১২ জন পুরুষ চার দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েশিশু রয়েছে। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে যাতে সন্তানদের বাল্যবিয়ে না দেন এজন্য প্রকল্পের আওতায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের সদস্যদের আয়বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল পালন, বসতবাড়িতে শাক-সবজি চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
শুধু প্রশিক্ষণ নয়, অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে প্রকল্পের পক্ষ থেকে এককালীন আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে, যাতে তারা আয়বৃদ্ধিমূলক ক্ষুদ্রব্যবসা কিংবা উৎপাদমূলক কাজ শুরু করতে পারেন।
প্রশিক্ষণার্থীদের উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে তাদের সামনে নিজেদের সফলতার গল্প বলেন আমিনা বেগম ও মিনারা বেগম নামে সিএনবি প্রকল্পে আগের উপকারভোগী সফল দুই নারী। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা ব্যবসা করে রোজগার করছেন। এই দুই নারী কীভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পোল্ট্রি ফার্ম দিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন সে গল্প শোনান। তারা নিজেদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে না দিয়ে কীভাবে ভরণপোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন সে গল্পও উপস্থাপন করেন প্রশিক্ষণার্থীদের সামনে। এক ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন প্রশিক্ষণার্থীরা। চার দিনব্যাপী প্রশিক্ষণে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন।
সালেমা বেগম বলেন, ‘যে আয় করি তাতে সংসারের খরচ জোগাতে পারি না। দুই মেয়ের পড়ালেখার খরচ দিতে ধার-দেনা করা লাগে। এখানে এসে অনেক কিছু শিখলাম। আমি বসতবাড়িতে সবজি চাষের পাশাপাশি সুপারির ব্যবসা করার চিন্তা করছি। আমার স্বামী বেঁচে থাকাতে সুপারির ব্যবসা করতেন। ওই ব্যবসা আমার জানা আছে। কষ্ট হলেও আমার মেয়েদের পড়াশোনা করাবো। তাদের উপযুক্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবো না।’
মনোয়ারা বেগম, জেসমিন আক্তার ও মুকুল মিয়া নামে কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী জানান, তারা প্রতিজ্ঞা করেছেন সন্তানদের বাল্যবিয়ে দেবেন না। কষ্ট করে হলেও উপযুক্ত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এই প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে তারা বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করবেন। সেই আয় দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগান দেবেন।
জেসমিন বলেন, ‘সংসারের কাজের সঙ্গে আমিও কিছু একটা করতে চাই। আমি এখানে অনেক কিছু জানছি। কীভাবে বাড়তি আয় করা যায় সেটা জানতে পারছি। মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিলে কী কী ক্ষতি হয় সেটাও জানছি। আমি মেয়েকে যতদূর পারি পড়াবো। বাল্যবিয়ে দেবো না।’
সিএনবি প্রকল্পের কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী অলিক রাংসা বলেন, ‘এনআরকে-টেলিনথ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ, বিশেষ করে, কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার কমিয়ে আনা। বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে শিশুদের পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এই প্রকল্পের একটি অংশ। যাতে পরিবারগুলো মেয়ে শিশুদের বোঝা মনে না করে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে। সেই লক্ষ্য অর্জনের অংশ হিসেবে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।’