|
প্রিন্টের সময়কালঃ ২৮ জুলাই ২০২৫ ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৬:৫৬ অপরাহ্ণ

শেষ হলো ৫ দিনব্যাপী ‘পদ্মপুরাণ-ভাসান গান উৎসব’


শেষ হলো ৫ দিনব্যাপী ‘পদ্মপুরাণ-ভাসান গান উৎসব’


আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-


 

কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পদ্মপুরাণ বা মা মনসামঙ্গল গানের আসর কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় আবারও ফিরিয়ে এনেছে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। গত মঙ্গলবার শুরু হয়ে পাঁচদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই ‘পদ্মপুরাণ-ভাসান গান উৎসব’ গতকাল শনিবার রাত ১২ টায় শেষ হয়। এ গীতিনাট্য উৎসব ঘিরে নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল এলাকায় যেন জমে উঠেছিল এক গ্রামীণ মিলনমেলা, দর্শকের উপচে পড়া ভিড়ে মুখর ছিল পুরো মাঠ।

 


 

স্থানীয় যুবক মনিন্দ্র চন্দ্র মন্ডলের উদ্যোগে আয়োজিত এ উৎসবে পদ্মপুরাণ, বেহুলা-লখীন্দর এবং শিব-পার্বতীর নানা পালা পরিবেশন করেছেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার কৈলাশ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন ১২ সদস্যের গীতিনাট্য দল।
 

উৎসবের চতুর্থ রাতে পরিবেশিত হয় ‘বেহুলার বাসর ও লখীন্দরের মৃত্যু’ পালা। সেখানে পুরুষ শিল্পীরা নারী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের চোখে এক অদ্ভুত আবেগঘন বাস্তবতার ছোঁয়া এনে দেন। কিশোরী মেয়েদের বিয়ের সাজে ‘বেহুলা-লখীন্দর’ বা ‘শিব-পার্বতী’র অভিনয় মুহূর্তটি উপস্থিত হাজারো দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

 


 

গোরকমন্ডল বা ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, লালমনিরহাট, ভূরুঙ্গামারী, এমনকি দিনাজপুর, রংপুর থেকেও মানুষ ছুটে এসেছেন এই লোকজ সংস্কৃতির স্বাদ নিতে। 
 

আগত দর্শক প্রভাস কুমার রায় বলেন, “এই গান তো এক সময় প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় হতো। এখন আর দেখা যায় না। এত বছর পর আবার দেখলাম, খুব ভালো লাগলো।”
 

আয়োজক মনিন্দ্র চন্দ্র মন্ডল জানান, “আমার একক ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকেই এই আয়োজন। ৩৩ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থেকে শিল্পীদের আনা হয়েছে।
 

যারা এসেছে তারা পাঁচদিনব্যাপী অনুষ্ঠান করেছেন। দীর্ঘদিন পর এলাকার মানুষ এমন আয়োজন দেখে খুব খুশি।”
 

গানের প্রতিটি পালায় ছিল ঐতিহ্যবাহী কাহিনির সংলাপ ও গদ্যছন্দের মূর্ছনা। ‘সৃষ্টিপত্তন’, ‘শিব-পার্বতী মিলন’, ‘বেহুলার বাসর’, ‘লখীন্দরের মৃত্যু’ প্রতিটি পালায় পুরুষ শিল্পীরা সেজেছেন নারী চরিত্রে, কখনো দেবী, কখনো নববধূর ভূমিকায়। দর্শকের দৃষ্টি আটকে গেছে সেই রূপক ঐতিহ্যে।
 

গীতিনাট্য পরিচালক কৈলাশ চন্দ্র রায় বলেন, “ভাসান গান মানেই বেহুলা-লখীন্দরের গীতিনাট্য। আগে মাঠের ফসল উঠলে বিভিন্ন গ্রামে রাত জেগে এই গান পরিবেশন করা হতো।
 

এখন সেটা প্রায় হারিয়েই গেছে। রংপুর অঞ্চলে এটি বিষহরি গান বা পদ্মপুরাণ নামে পরিচিত। বিভিন্ন এলাকায় একে বলা হয় পদ্মার নাচন, বেহুলার নাচাড়ি কিংবা কান্দনী গান।”
 

তিনি আরও জানান, “আমরা ১২ জন শিল্পী পাঁচদিনের জন্য ৩৩ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে এসেছি। এখন আর আগের মতো ডাকা হয় না, কারণ ব্যয় অনেক। ধনাঢ্য কিছু হিন্দু পরিবার মানতের কারণে এর আয়োজন করে। পেশাদার শিল্পীদের জন্য এই কাজ করে সংসার চালানো কঠিন।”
 

অভিনয় শিল্পী হিসেবে কাজ করেন কমল চন্দ্র রায়, পুষ্প চন্দ্র বর্মন, মনি শংকর রায়, অন্তর রায় ও সুমন চন্দ্র বর্মন।
 

কমল চন্দ্র রায় বলেন, “আমরা ১০-১৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে আছি। আগে প্রতি মৌসুমে ডাক পড়ত বিভিন্ন জেলায়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও রংপুরে। এখন হয়তো বছরে এক-দুইটা অনুষ্ঠান হয়। এখন আর এটাকে পেশা হিসেবে ধরে রাখা যাচ্ছে না। অবসরে দিনমজুরি করে উপার্জন করি।’
 

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আলম মিয়া বলেন, “অনেক বছর আগে গ্রামে পদ্মপুরাণ গান দেখেছি। এবার ছেলে- মেয়েরাও দেখার সুযোগ পেল। এই ধরনের অনুষ্ঠান নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের সংস্কৃতির চর্চা তুলে ধরছে।”
 

স্থানীয় ইউপি সদস্য শ্যামল চন্দ্র মন্ডল বলেন, “আমরা ছোটবেলায় রাতভর এই গান শুনতাম। এই গানে শুধু কাহিনী না, ছিল মায়া-মমতা, পূজা-পার্বণ, স্বামীভক্তি আর মানুষের বিশ্বাস। এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ সংস্কৃতি রক্ষায় এমন আয়োজন আরও হওয়া দরকার।”
 

পদ্মপুরাণ-ভাসান গানের পাঁচদিনব্যাপী উৎসব শুধু একটি গানের আসর নয়, এটি ছিল হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের এক আবেগঘন পুনরাগমন। যেখানে বেহুলার কান্না, শিব-পার্বতীর প্রেম, দেবতার অভিশাপ মিলিয়ে এক রঙিন শিল্পময় সন্ধ্যার সাক্ষী হলো কুড়িগ্রামের মানুষ। এ আয়োজন যেন স্মরণ করিয়ে দিল গ্রামবাংলার প্রাণ এখনও হারায়নি, শুধু অপেক্ষা করছে কে তাকে আবার জাগিয়ে তুলবে।


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫