সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়লেও জিনিসের দাম বাড়ে না ভারতে

প্রকাশকালঃ ১০ জুন ২০২৩ ০২:০৮ অপরাহ্ণ ১০৫ বার পঠিত
সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়লেও জিনিসের দাম বাড়ে না ভারতে

৪২ কোটির দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে সরকারি কর্মীর সংখ্যা তিন কোটির মতো (সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপকদের ধরে)। সংখ্যার হিসাবে তারা নগন্য।

এখানেই শেষ নয়, ১৪ লাখ সেনা-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীর সংখ্যা ৪৮ লাখ। এর মধ্যে যারা খুব বেশি মাইনে পান, সেই উচ্চপদস্থ আমলাদের সংখ্যা দুই দশমিক আট শতাংশ মাত্র। তাদের বলা হয় গ্রুপ এ কর্মী। আর নিচের তলার কর্মী, যাদের গ্রুপ সি ও ডি বলা হয়, তাদের সংখ্যা প্রায় ৮৯ শতাংশ। তাদের বেতনের সঙ্গে ছোট বা বড় আমলার বেতনের কোনো তুলনাই চলে না। সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে এখন কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ন্যূনতম বেতন হলো ১৮ হাজার টাকা। আর আইএএসেরন (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিসস্ট্রেটিভ সার্ভিস) সচিব পর্যায়ের অফিসারদের বেতন মাসে আড়াই লাখ টাকা। তার সঙ্গে অবশ্য সরকারি গাড়ি-বাড়ি-সহ কিছু সুযোগ সুবিধা আছে।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্য়ানেজমেন্ট (আইআইএম) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি (আইআইটি) পাস করে যারা বের হচ্ছে, তাদের অনেকে চাকরি জীবন শুরুই করছে বছরে এক কোটি টাকার বেতন দিয়ে। একদিন আগেই আইআইটি চেন্নাইয়ের প্রধান হাসিমুখে টিভি-তে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানাচ্ছিলেন, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবার ২৫ জন ছাত্রছাত্রী বছরে এক কোটি টাকা বেতন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থায় ঢুকছে। সব আইআইটি মিলিয়ে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্রছাত্রী বছরে এক কোটি টাকার বেশি প্যাকেজ নিয়ে চাকরিজীবন শুরু করছে। ক্যাবিনেট সচিব ও বিভিন্ন দপ্তরের সচিবরা চাকরি জীবনের শেষে এসে যে অর্থ পাচ্ছেন, তার থেকে চারগুণ অর্থ নিয়ে এই ছাত্রছাত্রীরা চাকরিজীবন শুরু করছে।


দিল্লির ভালো ভালো কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরই ছেলেমেয়েরা রাশি রাশি বেতন পাচ্ছে। লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে বছরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা বেতন নিয়ে চাকরিতে ঢোকা কোনো ব্যাপার নয়।  যে কোনো বিষয়ে স্নাতক হওয়ার পর ভালো কলেজগুলো থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে ১২ থেকো ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ নিয়ে চাকরিতে যোগ দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। আইটি, অর্থলগ্নি সংস্থা, বিপিও, বড় কর্পোরেট, বহুজাতিক সংস্থা এমনকী স্টার্ট আপ, ব্যাংকের মতো বিভিন্ন সংস্থা তাদের কর্মীদের সরকারের তুলনায় অনেক বেশি বেতন দেয়। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু সিনিয়র পর্যায়ের অধ্যাপকেরা মাসে আড়াই লাখ টাকা করে পাচ্ছেন। ফলে একটা সময় সরকারি চাকরি নিয়ে যে উন্মাদনাটা ছিল, তা আর এখন নেই। কারণ, সরকারি চাকরির থেকে অনেক বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে বেসরকারি কোম্পানিতে।

ভারতে আবার যখন তখন সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ে না। প্রতি দশ বছর পর পর বেতন কমিশন গঠন করার কথা। তাদের সুপরিশ অনুসারে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ার কথা। সপ্তম বেতন কমিশন সরকারি কর্মীদের বেতন অনেকখানি বাড়িয়েছিল। আর সেই টাকা দিতে গিয়ে প্রবল অসুবিধায় পড়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। অধিকাংশ রাজ্য সরকার তো তারপর আর নিয়মিত ডিএ দিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে ডিএ-র দাবিতে সরকারি কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে নেমেছেন। সপ্তম বেতন কমিশন গঠিত হয় ২০১৪ সালে, তাদের  রিপোর্ট কার্যকর হয়েছিল ২০১৬ সালে। এখন আবার অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবিতে এখনো পর্যন্ত কান দেয়নি। কোনো রাজ্য সরকারই এতে আগ্রহী নয়। কারণ, প্রতিটি রাজ্য সরকার আর্থিক সংকটে আছে। তারা আর বোঝা বাড়াতে চায় না। তাই প্রতিবছর যতজন সরকারি কর্মী অবসর নিচ্ছেন, ততগুলো পদ ভর্তি করা হচ্ছে না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলিয়ে লাখ লাখ পদ খালি। কিন্তু সরকার সমানে কর্মী কমাতে চাইছে।


এমনিতে সরকারি কর্মীদের প্রতি বছর তিন শতাংশ হারে বেতন বাড়ে। সেই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে মানানসই ডিএ বাড়ার কথা। সেটাও বছরে দুই বার।  কিন্তু কেন্দ্র সেই ডিএ দিলেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্য সরকার সেই ডিএ দিতে পারে না। জনমোহিনী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতে আসার পর তা পূরণ করতে গিয়ে হাতে টাকা থাকে না।


ফলে জিনিসের দামের সঙ্গে সরকারি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির খুব যে সম্পর্ক আছে তা বলা যাবে না। তবে ছোটবেলায় দেখেছি, দুর্গাপুরের মতো শিল্পশহরে কর্মীরা দুর্গাপুজোর বোনাস পেলেই জিনিসের দাম বাড়ত। কারণ, ওই শহরে তখন ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ছিলেন সরকারি ও আধা সরকারি কর্মী। রেলশহরগুলিতেও একই ঘটনা ঘটত। কিন্তু ৯১ এর পর থেকে ভারত যখন উদার অর্থনীতির পথে হেঁটেছে, তখন থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেছে।  এখন তো ওই সব শহরের চাল-চরিত্র-চেহারা পুরো বদলে গেছে।

এখন বরং ভারতের বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে জিনিসের দাম বাড়ে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে বাড়ে, ভোটের আগে ও পরে দাম বাড়ে। নিন্দুকরা বলেন, দাম না বাড়লে হাজার হাজার কোটি টাকার ভোটপ্রচারের খরচ কে দেবে? কিছু ব্যবসায় কোনো শিল্পপতির একচেটিয়া দখলদারি থাকলে বাড়ে। কিছুদিন আগে সর্ষের তেলের দাম লিটারপ্রতি দুইশ টাকার বেশি হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকা। ওই ওঠাপড়ার সঙ্গে কীসের সম্পর্ক আছে, কোনো বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে কি না, তা অর্থনীতির ছাত্ররা অনেক ভেবেও বের করতে পারে না। মাংস কেন ৭০০ টাকা কিলোয় বিক্রি হয়, ইলিশ মাছ কেন দেড় হাজার টাকা কিলো দরে বিক্রি হয়, কারা কেনে, কেন কেনে--এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর সাধারণ মানুষের সামনে নেই। চাহিদা-যোগানের তত্ব এখানে অনেকসময়ই খাটে না। কাটা রুইয়ের কিলো ৫০০ টাকা করে, ছাল ছাড়ানো মুরগি ২২০ টাকা করে, বড় চিংড়ি ৬০০ টাকা করে, ছোট হলে ৪০০ টাকা, সেখানে একটা ইলিশ কিনতে প্রায় আড়াই হাজার টাকার ধাক্কা। তাও তো বাজারে একটা ইলিশও পড়ে থাকে না। কারণ, কিছু মানষের কেনার ক্ষমতা এতটাই বেড়ে গেছে যে সপ্তাহে এক বা একাধিক ইলিশ তারা অনায়াসে কিনে নিয়ে যান।


এমনকি আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক, আইটি, বিপিও, শিক্ষক, কর্পোরেট, বহুজাতিক সংস্থার কর্মীদের খরচ করার ক্ষমতা বেড়েছে। ব্যবসা ও শিল্প করে প্রচুর মানুষ ভালো টাকা রোজগার করছেন।  দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া, দামি জিনিস কেনার দিকে মানষের ঝোঁক অনেক বেড়েছে। দিল্লিতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের হাতে লেটেস্ট মডেলের আইফোন ঘোরে। শুক্রবার রাত থেকে রোববার রাত পর্যন্ত দিল্লি ও গুড়গাওতে ভালো রেস্তোরাঁয় জায়গা পাওয়া যায় না। লাইন দিতে হয়। এই রেস্তোরাঁ এখন কাতারে কাতারে আছে। দুইজনের রাতের খাবার অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। তাও সেখানে জায়গা মেলে না।

কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও দিল্লির রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ বা তার বেশি আসে মদের ওপর বসানো শুল্ক থেকে। ভারতের সব রাজ্যের গড় ধরলে রাজ্য যদি সাত টাকা আয় করে, তার মধ্যে এক টাকা আসছে মদের ওপরে শুল্ক থেকে। এর থেকে একটা ছবি স্পষ্ট, মদের পিছনে কত টাকা খরচ করছেন ভারতের মানুষ। এ তো গরিব মানুষের চুল্লু, ধেনোর মতো দিশি মদ নয়, দামি বিলিতি মদ থেকে এই টাকাটা আসছে। সেটা খরচ করার মতো ক্ষমতা মানুষের হয়েছে। তাই আড়াই কোটি সরকারি কর্মী যা খরচ করবেন, তার থেকে অনেক বেশি খরচ করবেন প্রায় ৪৫ কোটির মতো মধ্যবিত্ত মানুষ।

সন্দেহ নেই, সরকারি কর্মীদের বেতন আগের থেকে ভালো হয়েছে, কিন্তু তাদের বেতন বাড়লে বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে না। কারণ, তারা এখন নেহাতই সংখ্যালঘু। বরং বেসরকারি সংস্থার রমরমা। তারাই বাজারকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে।