রক্তের একটি জটিল রোগের নাম থ্যালাসেমিয়া। এটি একটি বংশগত রক্তের রোগ। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগে থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণা উৎপাদিত হয় না। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। মা অথবা বাবা, অথবা মা-বাবা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।
বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১০০ মিলিয়ন লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা এই জিন বহন করছে এবং প্রায় এক লাখ শিশু প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন বহন করছে এবং প্রায় ৪ শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বেশির ভাগ রোগীরই নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। বাংলাদেশে এই রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটু সচেতন হলেই রক্তের এই জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগে থাকে। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। মা অথবা বাবা, অথবা মা-বাবা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এই রোগ কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণা উৎপাদিত হয় না। এ কারণে তাদের নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করে বেঁচে থাকতে হয়। রক্তের হিমোগ্লোবিনের মধ্যে অবস্থিত প্রোটিন চেইন অর্থাত্ পলিপেপটাইড চেইনের ধরন এবং পলিপেপটাইড চেইনের ত্রুটির ধরন অনুযায়ী এই জন্মগত রোগগুলো হয় কয়েকভাবে। যেমন—বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর, বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট, হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন-ই ট্রেইট, হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন-এস (সিকল সেল ডিজিজ), হিমোগ্লোবিন-ডি পাঞ্জাব, এইচপিএফএইচ।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অবসাদ অনুভব, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), অস্বস্তি, অস্বাভাবিক অস্থি, প্লিহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, সংক্রমণ, মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, হৃপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১০০ মিলিয়ন লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং প্রায় এক লাখ শিশু প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫.৩ মিলিয়ন লোক ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের বাহক, যা হিমোগ্লোবিন-ই নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে এ রোগের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক স্বল্প জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৩ শতাংশ মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন বিটা থ্যালাসেমিয়া ও ৪.৮ মিলিয়ন হিমোগ্লোবিন-ই-এর বাহক। সে হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন বহন করছে এবং প্রায় ৪ শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক হাজার ৪০ শিশু বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং প্রায় ছয় হাজার ৪৪৩ শিশু হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যাদের প্রতি মাসে রক্ত পরিসঞ্চালন করাতে হয়। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে বিটা থ্যালাসেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন-ই ডিস-অর্ডারই বেশি দেখা যায়। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে বাংলাদেশে হিমোগ্লোবিন-ই-এর বাহক এবং বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক বেশি।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রক্তের বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করাতে হবে। CBC ও Hb Electrophoresis পরীক্ষা দ্বারা থ্যালাসেমিয়া রোগ ও থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় করা হয়। এই রোগটি নিশ্চিতকরণের জন্য থ্যালাসেমিয়া জিনের মিউটেশন বিশ্লেষণ বা ডিএনএ বিশ্লেষণও করা হয়।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে কোন ধরনের থ্যালাসেমিয়ায় রোগী আক্রান্ত ও তার তীব্রতা কতটুকু। মৃদু থ্যালাসেমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহকদের সাধারণত মৃদু উপসর্গ দেখা দেয় এবং সামান্য চিকিৎসার দরকার পড়ে। কখনো কখনো রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের পর, গর্ভধারণের সময়, সন্তান প্রসব করার পর এবং থ্যালাসেমিয়ার জটিলতা বৃদ্ধি পেলে তা নিরাময় করার জন্য। মাঝারি থেকে তীব্র থ্যালাসেমিয়ার অন্তর্গত রোগীকে প্রায়ই রক্ত পরিসঞ্চালন করাতে হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ পর পর আবার কারো কারো ক্ষেত্রে প্রতি মাসে। শরীরে পুনঃপুনঃ রক্ত সঞ্চালনের কারণে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়, যা হার্ট, লিভার ও অন্যান্য অঙ্গকে নষ্ট করে দিতে পারে। শরীর থেকে এই অতিরিক্ত আয়রন বের করার জন্য ওষুধ নিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীদের পূর্ণাঙ্গ রোগমুক্তির উপায় হচ্ছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন অথবা জিন থেরাপি। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
থ্যালাসেমিয়ার বংশানুক্রমিক বংশবিস্তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেই এই রোগ পরিপূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। মা অথবা বাবা, এর যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ এবং পরিপূর্ণ সুস্থ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। যদি মা ও বাবা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তবে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জন্মানোর আশঙ্কা শতকরা ২৫ ভাগ, থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ এবং সন্তান পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। মা কিংবা বাবা, এর যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তাঁদের প্রতিটি সন্তানই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবে। মা ও বাবার মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ও একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ এবং সন্তান থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। যদি মা ও বাবা দুজনই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন, তবে তাঁদের সব সন্তানই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে।
সুতরাং যদি কোনো বাহক অন্য বাহককে বিয়ে না করে, তবে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমতে থাকবে। এ জন্য বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ে উভয়েরই রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। যদি একজন বাহকের সঙ্গে একজন সুস্থ মানুষের বিয়ে হয়, তবে সন্তান বাহক হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা জিন বহন করছে, তারা প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। বিয়ের পরে যদি থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান নিতে হবে। এভাবেই এই নীরব ঘাতক রোগটিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত এই রোগ সম্পর্কে জানা এবং অপরকে জানানো।
থ্যালাসেমিয়া রোগের ভয়াবহতা ও এই রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এটি ভবিষ্যতে মহামারি আকার ধারণ করবে বিবেচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে ২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলার। সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জনসচেতনতা ও যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়ামুক্ত হোক, এই কামনা করি।
লেখক : অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, হেমাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ল্যাব ওয়ান ফাউন্ডেশন অব থ্যালাসেমিয়া