সমকামী বিয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নেপাল

প্রকাশকালঃ ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০২:০৪ অপরাহ্ণ ১৮২ বার পঠিত
সমকামী বিয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নেপাল

মকামী বা সমলিঙ্গের বিয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল। এক দম্পতির বিয়ের স্বীকৃতি এই অঞ্চলের এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকারীদের জন্য যুগান্তকারী ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।

গত নভেম্বরে সুরেন্দ্র পান্ডে ও মায়া গুরুং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দেশটিতে সমলিঙ্গের বিবাহ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম দম্পতি তারা। শুধু তা-ই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এটি প্রথম এমন ঘটনা, যা এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকারীদের জন্য যুগান্তকারী ঘটনা।

২৭ বছর বয়সী পান্ডে সিসজেন্ডার বা জন্মগত পরিচয়ে পুরুষ। অন্যদিকে ৩৮ বছর বয়সী গুরুং ট্রান্সজেন্ডার নারী। তবে নেপালের আইনগত পরিচয়ে তিনি একজন পুরুষ।


পান্ডে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আইনগত এই স্বীকৃতি অর্জন শুধু আমাদের জন্য নয়, গোটা এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর জন্য অবিস্মরণীয় এক বিজয়। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ও নিজের কমিউনিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

দীর্ঘ আইনি লড়াই

স্বীকৃতি আদায়ের এই লড়াই মোটেও সহজ ছিল না তাদের জন্য। আইনগত প্রক্রিয়ার জটিলতা পাশাপাশি ছিল সমাজ ও পরিবারের চাপও। ২০১৭ সালে পান্ডে ও গুরুং হিন্দু রীতিতে বিয়ে করেন। কিন্তু স্বীকৃতি পান তারা ছয় বছরের লড়াইয়ের পর।

২০০৭ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বিদ্যমান আইনের ধারা পরিবর্তন করে সমলিঙ্গের বিবাহের অনুমতি দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সমলিঙ্গের বিয়ের স্বীকৃতি দেয়ার আইন পাস করতে ব্যর্থ হয় পরবর্তী সরকার।


এরমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে আইন পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত সমলিঙ্গের বিয়ের জন্য একটি অন্তর্বর্তী নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশনা দেন।

পান্ডে ও গুরুংয়ের আশা ছিল এতে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি সহজে এগোবে। কিন্তু জেলা আদালত ও আরেকটি উচ্চ আদালত তাদের বিয়ে নিবন্ধনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।  কারণ হিসেবে আদালত জানায়, সুপ্রিম কোর্টের রুলের পরও দেশের আইন বিপরীত লিঙ্গের বিবাহেরই শুধু স্বীকৃতি দেয়।


নিম্ন আদালত নেপালের সিভিল কোড বা দেওয়ানি বিধি অনুসারে রায় দেয়। এই বিধিতে বিয়ে হতে পারে শুধু নারী ও পুরুষ পরিচয়ের দুই ব্যক্তির মধ্যে। তবে নভেম্বরে শেষ সপ্তাহে নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় সব স্থানীয় প্রশাসনিক দপ্তরে সমলিঙ্গের বিবাহ নিবন্ধনের অনুমতি রয়েছে।

অবশেষে ২৯ নভেম্বর পান্ডে ও গুরুং সমলিঙ্গের পরিচয়ে লামজুং জেলার দরদি পৌরসভা থেকে বিবাহের সনদ নেন। পান্ডে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য অনেক কিছুর দুয়ার খুলে দিয়েছে। যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সম্পত্তির মালিকানা পাওয়া এবং ভবিষ্যতে শিশু দত্তক নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’


নেপালের এলজিবিটিকিউদের উৎসব

লামজুংয়ের স্থানীয় মানুষজন নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই যুগলের বিয়ে উদযাপন করেন।  কাঠমান্ডুর অদূরে প্রাচীন নগরী কীর্তিপুরে এই বিয়ের স্বীকৃতি উদযাপন করেন এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর মানুষেরা।

এই উৎসবে অংশ নেয়াদের একজন ঘোষিত সমকামী আইনজীবী সুনিল বাবু। তার মতে এই স্বীকৃতি নেপালের সমাজের প্রগতিশীল পরিবর্তনের ইঙ্গিত।


২০১৫ সাল থেকে নেপালের সরকার পাসপোর্টে লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে নারী, পুরুষের সাথে ‘অন্যান্য’ শব্দটি যুক্ত করে। ২০২১ সালে আদমশুমারিতে ‘অন্যান্য’ পরিচয় যুক্ত হয়। প্রায় তিন কোটি মানুষের মধ্যে দুই হাজার ৯২৮ জন তাদেরকে এই পরিচয়ে শনাক্ত করেছেন।

ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘নেপালের সমাজ এইক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ও ইতিবাচক।’ এর ফলে গোটা নেপালে লিঙ্গ পরিচয়ের দিক থেকে সংখ্যালঘুদের অধিকারের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা মিলবে। পান্ট জানান, নেপালে দুই শতাধিক সমলিঙ্গের ও ট্রান্সজেন্ডার বিবাহিত যুগল রয়েছেন, যারা এখন তাদের বিয়ের নিবন্ধনে এগিয়ে আসবেন।

সেইসঙ্গে আশেপাশের দেশগুলোতেও সমলিঙ্গের বিয়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে বলে আশা তার। যদিও প্রতিবেশী ভারতে গত অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গের বিয়ের বিপরীতে রায় দিয়েছে।


বিরোধিতাও আছে

নেপালের এই যাত্রা একদিনে সম্ভব হয়নি। দিন দিন কমে আসলেও নেপালের রক্ষণশীলদের একটি অংশ এখনও সমলিঙ্গের বিয়ের বিপক্ষে। দেশটির রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্র পার্টির চেয়ারপার্সন ও সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী কমল থাপা সমলিঙ্গের বিয়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, এর ফলে ‘বিয়ের পবিত্রতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের’ লঙ্ঘন হবে।

তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তি মানুষের প্রেম ও একসঙ্গে থাকার অধিকারের সমর্থন করি। কিন্তু যখন সমলিঙ্গের বিয়ে আমাদের বিয়ের যে মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা তার বিরোধী, যা ঐতিহ্যগতভাবে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর একটি পবিত্র মিলনকেই মূর্ত করে।’

গুরুং তার পরিবারের সমর্থন পেলেও পান্ডে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে এই বিয়ের ব্যাপারে পুরোপুরি সমর্থন পাননি। চার মাস আগে ‘মায়াকো পাহিচান' (ভালোবাসার পরিচয়) নামে একটি সংগঠন খুলেছেন তারা। এলজিবিটিকিউ মানুষদের অধিকার আদায় ও লিঙ্গ পরিচয়ের দিক থেকে সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক বিয়ে নিয়ে তারা কাজ করতে চান এর মাধ্যমে।