আধুনিক ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর বয়স কত?

প্রকাশকালঃ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০১:৩৩ অপরাহ্ণ ১৭৬৮ বার পঠিত
আধুনিক ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর বয়স কত?

পৃথিবীতে মানুষের বসবাস প্রায় ৩০ লাখ বছর। অথচ সেই তুলনায় খোদ মাতৃগ্রহের বয়স নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু মাত্র সেদিন বলা যায়। মাত্র ৩০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তবে পৃথিবীর সঠিক বয়স সম্পর্কে জানা গেছে এই সেদিন। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর এই বয়স নির্ধারিত হলো কীভাবে? আর তা নির্ধারণে আমাদের এত সময়ই বা লাগল কেন? কোনো মানুষ বা প্রাণীর বয়স নির্ধারণের জন্য তার জন্মসাল জানার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পৃথিবীর জন্মের সময় তো কোনো মানুষই ছিল না। তাহলে কীভাবে সম্ভব হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে তিন শতাব্দী পেছনের কথা জানতে হবে।

 

পৃথিবীর বয়স সম্পর্কে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা মানুষের পক্ষে সহজ কাজ ছিলো না। ১৬শ শতাব্দীর ইংরেজ স্কলার জন লাইটফুটের কথাই ধরা যাক। জন লাইটফুট হঠাৎ একদিন বিজ্ঞান মহলে ঘোষণা করলেন পৃথিবী খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৬ অক্টোবর ঠিক রাত ৯টায় সৃষ্টি হয়েছিলো!

 

 

দিন যতই গড়াতে লাগল, ততই ভূতাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন বিষয় বুঝতে শুরু করলেন। তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন, লাইটফুটের কথামতো পৃথিবীর বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর হতে পারে না। কারণ, আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিলো ডায়নোসরদের বসবাস। কাজেই বয়স নির্ধারণে তাঁরা নতুন পদ্ধতির খোঁজ চালালেন। এসবের মধ্যে আছে পৃথিবী বা সূর্য বর্তমান তাপমাত্রায় এসে পৌঁছাতে কত সময় লেগেছে তা নির্ণয় করে, সমুদ্র স্তরের পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে এবং সাগরের লবণাক্ততার পরিমাণ পরীক্ষা করে। কিন্তু সব পদ্ধতিই একসময় অনির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।

 

তাছাড়া বর্তমানে আমরা পৃথিবীর জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতি যেমনটা দেখছি, অনেক আগে তেমনটা ছিলো না। সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী ছিলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত এক আগুনের গোলক। কোটি কোটি বছরের সুদীর্ঘ বিবর্তনের ফলে তা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়। সুতরাং বলা যায়, পৃথিবীর সৃষ্টি একদিনের কোনো ঘটনা নয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই গণনায় সাহায্য করেছে। তেজস্ক্রিয় পরমাণু থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হতে থাকে। একে বলে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। তেজস্ক্রিয় মৌল তেজস্ক্রিয় ক্ষয় করে সম্পূর্ণ অন্য মৌলে পরিণত হয়। যেমন ইউরেনিয়ামের কথা ধরা যাক। তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম রশ্মি ক্ষয় করে সিসায় পরিণত হয়। তবে এই তেজস্ক্রিয় ক্ষয়টা একবারে হয় না। হয় নির্দিষ্ট হারে। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের এই হারটা একেক তেজস্ক্রিয় পদার্থের জন্য একেক রকম। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হিসাবে আসে অর্ধায়ু নামে একটা শব্দ। কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধেক ক্ষয় হতে যত সময় লাগে তাকে ওই পদার্থের অর্ধায়ু বলে।

 

ইউরেনিয়ামের পরমাণু ক্ষয় হয়ে অর্ধেকে পরিণত হতে সময় লাগে ৪৫০ কোটি বছর। তার মানে ৪৫০ কোটি বছরে এক লাখ পরমাণু ক্ষয়ে ৫০ হাজার ইউরেনিয়াম অবশিষ্ট থাকে। বাকি ৫০ হাজার পরমাণু সিসার পরমাণুতে রূপান্তরিত হবে। এখানে এক লাখ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১০০ পরমাণুর একটা ইউরেনিয়াম খণ্ড নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে ৪৫০ কোটি বছর পর ৫০টি ইউরেনিয়াম অক্ষত আছে, বাকি ৫০টি সিসায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ যত পরমাণুই নেওয়া হোক, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম অর্ধেকে পরিণত হতে সময় লাগে ৪৫০ কোটি বছর। একে ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু বলে। অনেকেই ভাবছেন, ৪৫০ কোটি বছরের হিসাব কিভাবে বের হলো? অত দিন তো মানুষ বাঁচে না!

 

 

মানুষ বাঁচে না- এটা ঠিক। তার পরও বের করার একটা পদ্ধতি আছে। আছে একটা গাণিতিক সমীকরণ। প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি ক্ষয় হচ্ছে, তা হিসাব করে ওই গাণিতিক সমীকরণে বসানো হয়। সেখান থেকে যে ফল বেরোয়, সেটাই তার অর্ধায়ু। এই সমীকরণটা যে ঠিক, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যেসব তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু কম তাদের ক্ষেত্রে। 

 

পৃথিবীর তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ বিভিন্ন শিলাখণ্ড নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সবগুলোতেই একটা জিনিসের মিল আছে। তা হলো, এর অর্ধেক ইউরেনিয়াম অর্ধেক সিসার। তার মানে দুনিয়ার সব ইউরেনিয়াম শিলাখণ্ড এখন অর্ধায়ুতে অবস্থান করছে। তার মানে এদের বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। অর্থাৎ প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে এসব শিলাখণ্ড সৃষ্টি হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিলাখণ্ডগুলো সৃষ্টির সময়কে যদি পৃথিবী সৃষ্টির সময় ধরে নেওয়া হয়, তা হলে আধুনিক ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে।