মুহাসাবা শব্দটি আরবি। এর অর্থ আত্মপর্যালোচনা। আত্মপর্যালোচনা হলো নিজের ভালো-মন্দ কাজের জন্য নিজের কাছে জবাবদিহি করা। মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করা, ভবিষ্যতে তা না করার অঙ্গীকার করা।
আর ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর কাছে আরো বেশি তাওফিক চাওয়া। আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে মানুষ নিজের আমল ও কর্মের হিসাব নিজেই করে। এটি মুমিনের দৈনন্দিন রুটিন। আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার সুযোগ পায়।
ইসলামে মুহাসাবা ও আত্মপর্যালোচনার গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ আত্মপর্যালোচনার প্রতি উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ১৮)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লেখেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
এ আয়াতে তিনি ইঙ্গিত করেছেন—তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে আখিরাতের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, নাকি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? (মাদারিজুস সালেকিন, ১/১৮৭)
আত্মপর্যালোচনা বিষয়ে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের আমলগুলো ওজন কোরো তোমাদের বিরুদ্ধে তা ওজন করার আগে। কেননা আজ তোমাদের নিজেদের হিসাব গ্রহণ আগামীকাল অন্যকে হিসাব দেওয়ার চেয়ে সহজতর।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৪/৪০২; মিনহাজুল মুসলিম, পৃষ্ঠা ১২১)
হাদিস থেকেও আত্মসমালোচনা ও আত্মপর্যালোচনার ধারণা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়।
আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)
মাইমুন ইবনে মিহরান (রহ.) বলতেন, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকি হতে পারে না, যতক্ষণ না সে আত্মপর্যালোচনায় কঠোর না হয়। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, পৃষ্ঠা : ৪২৯)
আত্মপর্যালোচনা কেন প্রয়োজন
আত্মসমালোচনা ও আত্মপর্যালোচনার চর্চা মুমিনকে পদস্খলন থেকে রক্ষা করে; আত্মোন্নয়নে সহায়তা করে। আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে নিজের অপরাধ সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়, আল্লাহর হক সম্পর্কে সতর্ক থাকা যায়, আত্মশুদ্ধির প্রেরণা জাগ্রত হয়, আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা যায় এবং আখিরাতের হিসাব সহজ হয়। আত্মপর্যালোচনা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, মনিবের সঙ্গে দাসের সর্বোপরি মানুষের সঙ্গে মানুষের ইনসাফপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
যেসব বিষয়ে আত্মপর্যালোচনা হবে
আত্মপর্যালোচনার সময় কোন কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে—তার ধারণা নিম্নোক্ত হাদিসে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মানুষ আল্লাহর সামনে এক পা অগ্রসর হতে পারবে না। তা হলো : জীবন কোথায় নিঃশেষ করেছ?, যৌবন কোথায় ব্যয় করেছ?, সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছ? তা কোথায় ব্যয় করেছ? যা জেনেছ তার কতটা আমল করেছ?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)
আত্মপর্যালোচনার স্তর
আত্মপর্যালোচনার দুটি স্তর আছে। প্রথম স্তর হলো—যেকোনো কাজের আগে পর্যালোচনা করা। কাজটি যদি সাধ্যাতীত হয় তাহলে সে পথে পা না বাড়ানো। আর যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে তাহলে চিন্তা করবে কাজটি দুনিয়া ও আখিরাতে তার কতটুকু উপকার বয়ে আনবে? যদি সেটি অনর্থক কাজ হয়, তাহলে সেটা ত্যাগ করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৮)
অতঃপর কাজটি যদি উপকারী হয়, তাহলে কাজটি ইখলাসের সঙ্গে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের মুহাসাবা হলো কার্যসম্পাদনের পর। ভালো কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে মানবীয় দুর্বলতার কারণে কোনো ভুল হয়ে গেলে ভুলের জন্য ইস্তেগফার করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে আর তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বিনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পড় এবং ইস্তেগফার করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা : নাসর, আয়াত : ১-৩)
আত্মপর্যালোচনা কখন করবে
একজন মুমিন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বার্ষিক কর্মকাণ্ডেরও হিসাব করে থাকে। অতীত জীবন শুধরে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর করার চেষ্টা করে। ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবকাশে পীড়িত অবস্থার জন্য সঞ্চয় করে রেখো। আর জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ো।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৫৩)
আত্মপর্যালোচনার প্রতিদান
এ উম্মতের সৎকর্মশীল বান্দারা আত্মসমালোচনা ও আত্মপর্যালোচনা করতেন, ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করতেন এবং তাকে নিজের খেয়াল-খুশিমতো চলা থেকে বিরত রাখতেন। আর এভাবে জীবন অতিবাহিত করার প্রতিদান জান্নাত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।’ (সুরা : নাজিআত, আয়াত : ৪০-৪১)