কুষ্টিয়ায় চুরির অভিযোগে দুই কিশোরকে রাতভর নির্যাতন, সকালে জরিমানা আদায়
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় দোকানে চুরির অভিযোগে দুই কিশোরকে ডেকে নিয়ে রাতভর অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। রোববার (৯ নভেম্বর) গভীর রাতে তাদের মোবাইল ফোনে ডেকে আনা হয় এবং রাত ২টা থেকে সোমবার ফজরের আজান পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হয়। পরদিন সকালে সালিশ ডেকে তাদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এক কিশোরের মায়ের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
ঘটনাটি ঘটেছে কুমারখালীর জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারে। ভুক্তভোগী দুই কিশোরের বয়স ১৭ বছর, দুজনেই স্থানীয় বাসিন্দা। গত শিক্ষাবর্ষে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তারাপুর বাজারে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকান পরিচালনা করেন আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যক্তি। ওই দোকানেই স্থানীয় তরুণরা অবসর সময়ে ক্যারাম খেলত। রোববার সন্ধ্যায় আজাদের দাদি মারা গেলে তিনি দোকান বন্ধ করে দাদির বাড়ি যান। রাত ১১টার দিকে ফিরে এসে দেখেন দোকানের পেছনের দরজা খোলা এবং ড্রয়ারে রাখা টাকা, সিগারেটসহ কিছু পণ্য খোয়া গেছে। সন্দেহের ভিত্তিতে তিনি স্থানীয় দুই কিশোরের ওপর চুরির অভিযোগ তোলেন।
পরে রাত ২টার দিকে ফোনে তাদের ডেকে এনে দোকানে আটকে রাখেন আজাদ ও তার সহযোগীরা। শুরু হয় নির্মম মারধর। কাঠ ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেটানো হয় দুই কিশোরকে। একপর্যায়ে তারা ভয় পেয়ে চুরির দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান ও হাসানসহ কয়েকজন এই নির্যাতনে অংশ নেন।
নির্যাতনের ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোমবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে এক কিশোরের হাত-মুখ চেপে ধরে রেখেছে, অন্যজন লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। কিশোরটি আর্তনাদ করে বলছে, “আমি কিছু করি নাই, ও মা গো…”
সোমবার সকালে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও জগন্নাথপুর ইউনিয়ন সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাসের উপস্থিতিতে বাজারের পাশের একটি করাতকলে সালিশ বসানো হয়। সেখানে আজাদের ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই কিশোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এক কিশোরের মা ১০ হাজার টাকা দিয়ে দুজনকে বাড়ি নিয়ে যান। পরে আহত অবস্থায় তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়।
হাসপাতালে দেখা যায়, তাদের হাত, পা ও পিঠে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন। একজন কিশোর বলেন,
“আজাদের দোকানে আমরা নিয়মিত ক্যারাম খেলি। রাতে বাড়ি ফেরার পর আজাদ বারবার ফোন দেয়। পরে ওরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বাজারে যায়। ফজরের আজান পর্যন্ত লাঠি ও কাঠ দিয়ে মারধর করে।”
অন্য কিশোরের বক্তব্য,
“আমরা চুরি করিনি। তবুও সারারাত আমাদের পেটানো হয়েছে। সকালে করিম মেম্বার ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে। মা ১০ হাজার টাকা দেয়ার পর ছাড়া পাই।”
এক কিশোরের মা বলেন,
“আমার ছেলে চুরি করেনি। তবুও নির্দয়ভাবে মেরেছে। ছেলেকে বাঁচাতে জরিমানা দিয়েছি। এখন ন্যায়বিচার চাই।”
অপর কিশোরের মা জানান,
“আমরা থানায় যাব, মামলা করব। এমন মার কেউ মারে না!”
বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আবুল কালাম আজাদের দোকান বন্ধ। স্থানীয় কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। আজাদ বলেন,
“দাদি মারা যাওয়ার খবরে দোকান বন্ধ করে যাই। ফিরে এসে দেখি দরজা খোলা, টাকা-পয়সা নেই। পরে দুই কিশোরকে সন্দেহ করি। ওদের ডেকে আনি, মানুষজন ওদের মেরেছে, আমি না। পরে করিম ভাইয়ের সালিশে ৩০ হাজার টাকায় মীমাংসা হয়।”
তবে সালিশের বিষয়টি অস্বীকার করে আব্দুল করিম বিশ্বাস বলেন,
“চুরির অভিযোগে পিটুনি দিয়ে ওদের আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আনে। আমি তাদের সরিয়ে দিয়েছি। সালিশ করিনি।”
এ বিষয়ে কুমারখালী থানার ওসি খন্দকার জিয়াউর রহমান বলেন,
“ঘটনাটি সম্পর্কে শুনেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়া যায় না।”
এই ঘটনাটি এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, কিশোরদের ওপর এমন নির্যাতন বর্বরতার উদাহরণ, যা আইনের শাসনের প্রতি আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫