রাজ্জাককে হারিয়ে লক্ষ্মীকুঞ্জে নেই সেই হইহুল্লোড়

কলকাতার বাঁশদ্রোণী এলাকার খায়রুন্নেসার সঙ্গে বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রথম দেখা নাকতলার আবদুর রাজ্জাকের। প্রথম দেখাতেই খায়রুন্নেসাকে ভালো লেগে যায় তাঁর। এরপর নাকতলার বাড়িতে গিয়ে ভালো লাগার কথা ভাবিকে জানান রাজ্জাক। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাঁদের। অভিনয়ের টানে কলকাতা-মুম্বাই ঘুরে ঢাকায় এসে থিতু হন রাজ্জাক। একসময় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মহাতারকা হয়ে ওঠেন। নায়করাজ রাজ্জাক মহাতারকা হলেও স্ত্রী খায়রুন্নেসা ছিলেন ততটাই আড়ালে থাকা মানুষ। আড়ালে থেকেই জুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা। রাজ্জাকের জীবনে তিনি হয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মীরূপে। তাই তো একসময় ‘লক্ষ্মী’ নামেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। রাজ্জাকও তাই লক্ষ্মীকে নিয়ে ভালোবাসার বাগান বানিয়েছিলেন ঢাকার গুলশান ২ নম্বরে, যার নাম দিয়েছিলেন লক্ষ্মীকুঞ্জ। যে কুঞ্জ আজ থেকে ৬ বছর আগেও তারকাদের আনাগোনায় মুখর থাকত। রাজ্জাকও তখন সমসাময়িক এবং অনুজদের আপন করে ভালোবাসায় আগলে রাখতেন। এখন যেন সেই লক্ষ্মীকুঞ্জ একেবারে চুপচাপ, শান্ত, নিরিবিলি।
রাজ্জাককে হারিয়ে গুলশান-২-এর লক্ষ্মীকুঞ্জে নেই সেই হইহুল্লোড়। ২০১৭ সালের এই দিনে রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকে স্তব্ধ হয় চলচ্চিত্র অঙ্গন। সেই স্তব্ধতা আজও যেন জায়গা করে নিয়েছে লক্ষ্মীকুঞ্জের ব্যালকনিতে। যেখানে একটা চেয়ার পেতে বসতেন নায়ক রাজ্জাক। নাতি ও তাঁদের প্রিয় কুকুরটিকে নিয়ে খেলতেন। সেই ব্যালকনি এখন শূন্য।
চলে যাওয়ার এই দিনে গুলশানের লক্ষ্মীকুঞ্জে আজ সোমবার মিলাদ মাহফিল, এতিমদের খাওয়ানোসহ নানা আয়োজন করেছে রাজ্জাক পরিবার। মেজ ছেলে বাপ্পী এখন আছেন কানাডায়। তাই তো তিনি ছাড়া বাপ্পারাজ, সম্রাট, তাঁদের বোনসহ পরিবারের অন্য সবাই আজ মায়ের সঙ্গে লক্ষ্মীকুঞ্জে আছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে সম্রাট বললেন, ‘সকালে ফজরের নামাজের পর বাবার জন্য মিলাদ পড়ানো হয়। এরপর আশপাশের কয়েকটি এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা মিলে কোরআন খতম দেব।’
কথায় কথায় সম্রাট বললেন, ‘বাবাকে ছাড়া এই কয় বছর কীভাবে পার হয়ে গেল, ভাবতেই কেমন যেন লাগে। মনে হয়, আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যাননি। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। সব সময় আমরা এটাই অনুভব করি।’ বাসা থেকে বের হওয়া বা ঢোকার সময় বাবার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার অভ্যাস ছিল দুই ভাইয়ের। গত কয়েক বছর তা ভীষণভাবে মিস করছেন। লক্ষ্মীকুঞ্জের রেওয়াজ ছিল, একসঙ্গে সকালের নাশতা ও রাতের খাবার খাওয়ার। বাবার চেয়ারটা এখন খালি থাকে। শূন্য শূন্য লাগে সম্রাটদের। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই একসঙ্গে খাচ্ছি, গল্প করছি, আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ আব্বার চেয়ারটায় চোখ পড়লে খুব কষ্ট হয়।’
বেলা দুইটা বাজলে সন্তানকে ফোন করে খবর নিতেন রাজ্জাক। সম্রাট বলেন, ‘বাবা বলতেন, “এই তুই কই? অফিসে? আসবি কখন? আমি বসে আছি, একসঙ্গে খাব।” রাত ১০টা বাজলে শুটিংয়ে থাকলে ফোন করতেন, “কী রে, রাত ১০টা বাজে, শুটিং এখনো প্যাকআপ হয়নি। খাবি না? আমি কি খেয়ে নেব? ১১টা বাজবে? আমি ওয়েট করছি, আয় একসঙ্গে খাব।” আমি বলতাম, “আপনার ওষুধ আছে, আপনি খেয়ে নিন।”’ ছোট ছোট স্মৃতিগুলো মনে করতেই দুর্বল হয়ে যায় সম্রাটের কণ্ঠ। বলেন, ‘বাবার টাইম টু টাইম ফোন করে খবর নেওয়া, বিভিন্ন কাজে পরামর্শ দেওয়াটা খুব মিস করি। তিনি ছাড়া একেবারে শূন্য মনে হয়।’
রাজ্জাকের স্ত্রী খায়রুন্নেসা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও সন্তান ও নাতি-নাতনিরা মিলে চেষ্টা করেন প্রফুল্ল রাখতে। মায়ের একাকিত্ব ঘোচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন ছেলেরা। বাপ্পারাজের সন্তানদের জন্মের সময় রাজ্জাক অনেক ব্যস্ত অভিনেতা। সম্রাটের বড় সন্তান আরিশা যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন রাজ্জাক অভিনয় থেকে অনেকটাই দূরে। অভিনয় কমিয়ে দেওয়ায় নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতেন। আরিশার ছোট বোন আরিবাও দাদার সঙ্গে খেলাধুলা করত। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখত। এখন দাদা ছাড়া তারাও বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। হইহুল্লোড়ে মেতে থাকা লক্ষ্মীকুঞ্জ হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ। রাজ্জাকের শোবার ঘরের সবকিছু সাজানো আছে আগের মতোই, যেমনটা তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর কাপড়চোপড়, পারফিউম—এমনকি গোসলের সাবানও এখনো বাথরুমে রয়ে গেছে, যেভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলেন হাসপাতালের পথে।
রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালীগঞ্জে, বেড়ে ওঠাও সেখানে। ইচ্ছা ছিল খেলোয়াড় হওয়ার। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মঞ্চনাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য স্পোর্টস শিক্ষক তাঁকে বেছে নেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজ্জাক ছিলেন সবার ছোট। মেজ ভাইয়ের সাহায্যে অভিনয়জগতে আসার সব সহযোগিতা পান রাজ্জাক। এসএসসি পাস করার পর অভিনয় শুরু করেন। ধীরে ধীরে টিভি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান, জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন তিনি। কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে উত্তম কুমারের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্জাক। সংস্পর্শে আসেন তপন সিনহা এবং পরিচালক পীযূষ বোসের। পীযূষ বোসের পরামর্শেই ঢাকায় আসেন তিনি।
কলকাতায় টুকটাক অভিনয় করা রাজ্জাকের অভিনয়জীবনের বিকাশ ঘটে ঢাকাতেই। তবে শুরুর জীবনটা মোটেও সহজ ছিল না। কষ্টে দিনযাপন করতে হয়েছে। কলকাতার জায়গাজমি বিক্রি করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকা শুরু করেন। ঢাকায় থাকার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উৎসাহ আর আগ্রহ ছিল খায়রুন্নেসার। ১৯৬৪ সালে রাজ্জাক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যখন ঢাকায় আসেন, তখন প্রথম সন্তানের বয়স আট মাস। খায়রুন্নেসা বললেন, ‘ঢাকায় আমার এক খালা ও মামা থাকতেন। খালার বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলাম। এরপর আমরা কমলাপুরে বাসা নিই। এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তবে ও কয়েকবার বলেছে, চলে যাবে। আমি বলেছি, থাকি না এখানে। আমার তো এখানে ভালো লেগে গেছে। তারপর আমাকে রেখে কলকাতায় গেল। আমাদের জমি ছিল, বিক্রি করে চলে আসে।’
অভিনয়ের নেশায় স্ত্রী খায়রুন্নেসা ও বড় ছেলে বাপ্পারাজকে নিয়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসা রাজ্জাক শুরুর দিকে উঠেছিলেন কমলাপুরে। তারপর দিলু রোড, ফার্মগেটের পর থিতু হন গুলশান-২ নম্বর রোডের লক্ষ্মীকুঞ্জে। ছয় বছর ধরে ঠিকানা বদল হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য এই অভিনেতার। বনানীর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৬৬৯/১-এই ঠিকানায় তিনি চিরঘুমে। আর কোনো দিন নীল আকাশের নিচে হাঁটবেন না তিনি, গাইতে দেখা যাবে না কোনো অভিমানী গান। তাঁর এই চলে যাওয়াতে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকা লক্ষ্মীকুঞ্জও যেন নিষ্প্রাণ।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫