প্রকাশকালঃ
০১ জুন ২০২৩ ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ ৯৫ বার পঠিত
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানাতে বিশ্বনেতাদের মধ্যে যে তাড়াহুড়ো লক্ষ করা গেছে, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে শক্ত ধারণা পাওয়া যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তুরস্কের গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। ৬৯ বছর বয়সি এরদোয়ান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। গত রোববার দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী কামাল কিলিকদারোগলুকে হারিয়ে টানা তৃতীয় বারের মতো তুর্কি প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন তিনি। এরদোয়ান তার ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারায় বেশ আগেভাগেই অভিনন্দন জানান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ বিষয়ে তিনি এতটাই উত্সাহী ছিলেন যে, নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করা পর্যন্তও অপেক্ষা করেননি। সরকারিভাবে ফল ঘোষণার আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এরদোয়ানের ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ তার বিজয়ের অন্যতম কারণ।
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা : ইউক্রেনে পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরুর পর ন্যাটো জোটে তুরস্কের মিত্র দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে, তখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ক্রেমলিনকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। এছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের ব্যাপারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনাও হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া সমঝোতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এরদোয়ানের। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ উলটো উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এসব কারণে এরদোয়ানকে পছন্দ করতেই পারেন ভ্লাদিমির পুতিন। তবে বিশ্বনেতাদের মধ্যে শুধু যে রুশ প্রেসিডেন্টই এরদোয়ানকে দ্রুত অভিনন্দন জানিয়েছেন, তা নয়। এই দৌড়ে পিছিয়ে ছিলেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁও। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ন্যাটোর পক্ষ থেকেও এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
ন্যাটোর সম্প্রসারণ : ন্যাটো সম্প্রসারণের ব্যাপারে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জোটের সংবিধানে বলা হয়েছে, নতুন কোনো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে জোটের সব সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন। সম্প্রতি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার যে আবেদন জানিয়েছিল, সে বিষয়ে সবার দৃষ্টি ছিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দিকে। অনেক দ্বিধা ও সংশয়ের পর শেষ পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগদানে অনুমোদন দেন। কিন্তু সুইডেনের বিষয়টি এখনো ঝুলে রয়েছে। এরদোয়ান সরকারের অভিযোগ, সুইডেন কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি বা পিকেকের সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছে। তুরস্ক এই সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
নিরপেক্ষ নীতি : তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে একসময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রচুর চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তার সেই লক্ষ্য এখনো সফল হয়নি। তবে ইদানীং তিনি ইইউতে যোগদানের ওপর খুব বেশি জোর না দিয়ে বরং তুরস্ককেই ‘আবারও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছেন। এরদোয়ান তুরস্কের জন্য একটি ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ তৈরি করতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন।
ইউরোপের স্বার্থ : ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ ইউরোপীয় দেশগুলোতে শরণার্থী-অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি আশা করছেন, এই প্রবণতা ঠেকাতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট হয়তো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে পারবেন। ২০১৫ সালের অভিবাসনসংকটের সময় ১০ লাখের বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগরের বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে।
গ্রিস ও সাইপ্রাস ইস্যু : এসবের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধ রয়েছে। এজিয়ান সাগরের বেশ কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে এই বিরোধ। পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের বহু দ্বীপ রয়েছে, যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকূল থেকে দেখা যায়। ফলে সেখানে কার সমুদ্রসীমা কোথায়, তা নির্ধারণ এক জটিল ব্যাপার। অতীতে এ নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একই সঙ্গে ইইউর আরেক সদস্য দেশ সাইপ্রাসও এরদোয়ানের ওপর চাপ দিয়ে আসছে, যেন তুরস্ক সেখানকার সমস্যার ‘দুই দেশভিত্তিক সমাধানের’ পদক্ষেপ নেয়। এছাড়া তুরস্কের কৌশলগত গুরুত্বকে পশ্চিমা দেশগুলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর তুরস্কের এই অবস্থান বদলে গেছে।