ফিরেছে সাজেদা পরিবারের সচ্ছলতা, মেয়ে পেয়েছে বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি

ঢাকা প্রেস
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
‘অভাব অনটনের সংসার ছিল। স্বামীর দিনমজুরির টাকায় নুন আনতে পানতা ফুরাইতো। ছেলে-মেয়েকে ঠিকমতো খাবার দিতে হিমশিম খাইছিলাম। পড়াশোনা তো দূরের কথা মেয়েকে কত তাড়াতাড়ি বিয়া দিতে পারি সেই চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু এখন আর সেই টানাপোড়ন নাই। আল্লাহর রহমতে মাছ আর সবজি চাষের টাকা দিয়া অভাব মিটায় খেয়ে পড়ে চলতে পারতেছি। ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি। অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাও বাদ দিছি।’
কথাগুলো বলছিলেন মাছ চাষে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া গৃহবধূ সাজেদা বেগম। সাজেদার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত মালতিবাড়ি গ্রামে। স্বামী শাহজাহান আলী পেশায় দিনমজুর। স্বামী, দুই ছেলে-মেয়ে ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তার। সম্প্রতি সাজেদার গ্রামে তার প্রকল্পে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
সাজেদা জানান, তার স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াই মোটেও সহজ ছিল না। দিনমজুর স্বামীর সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। বয়োবৃদ্ধ শ্বশুর উপার্জন করলেও তা ছিল অনিয়মিত। এর মধ্যে স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অভাব অনটনে স্কুল পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। নিরুপায় হয়ে ভেতরে ভেতরে চলছিল পাত্রের খোঁজ।
অভাব মেটাতে সাজেদার পরিবার অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ শুরু করেন। কিন্তু ধান চাষের ব্যয়ের সংকুলান করতে পারছিলেন না। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। অভাব যেন তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। জীবন সংসারের এমন অন্ধকার সময়ে আলোর দিশা হয়ে পাশে দাঁড়ায় পান্ডুল ইউনিয়ন যুব সংগঠন। তাদের সহায়তার আরডিআরএসের চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের অধীন আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ আর এককালীন আর্থিক সহায়তায় ঘুরে যায় সাজেদার জীবন। শুরু হয় তার পরিবর্তনের গল্প।
সাজেদার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মাছ চাষের পরিকল্পনা নেন তিনি। স্বামী-শ্বশুরের সঙ্গে আলোচনা করে ইতিবাচক সাড়া মেলে। শুরু হয় প্রকল্পের যাত্রা। গ্রামের পূর্ব দক্ষিণ প্রান্তে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কের পাশে সাজেদার মৎস্য চাষ প্রকল্প। ২০২২ সালে ২০ শতক পুকুর দিয়ে যাত্রা শুরু করে সাথে বর্গা নেওয়া আরও ৮০ শতক জমির পাড় বেঁধে প্রকল্পভুক্ত করেন।
স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি সবার শ্রমে প্রস্তুত হয় এক একর আয়তনের প্রকল্প পুকুর। ওই পুকুরে মাছ আর পারে সবজি চাষ করে মাত্র তিন বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাজেদার পরিবার। মাছের সঙ্গে পুকুর পাড়ে চাষ করা সবজি বিক্রি করে বাড়তি আয়ের পাশাপাশি পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মিটছে।
সাজেদা বলেন, ‘মেয়ে তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। নিরুপায় হয়ে গেছিলাম। অভাবের তাড়নায় মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করতেছি এমন খবর পায় পান্ডুল ইউনিয়ন যুব সংগঠন। তাদের সহায়তার আরডিআরএসের সিএনবি প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর তারা ১৭ হাজার টাকা এককালীন সাহায্য দেয়। ওই টাকা দিয়ে পোনা কিনে মাছের চাষ শুরু করি। এরপর থেকে অভাব ঘুচে গেছে।’
সাজেদা আরও বলেন, ‘স্বামী আগের মতো দিনমজুরের কাজ করেন। আমি শ্বশুর-শাশুড়ি মাছ ও সবজি চাষে সময় দেই। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করি। যে আয় হয় তাতে সংসার ও চিকিৎসা খরচ ছাড়াও ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি। ভালো-মন্দ খেতে পারছি। প্রতি মাসে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারছি। ছেলে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে বিএ শ্রেণিতে আর মেয়ে স্থানীয় একটি স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়ে আরও পড়তে আগ্রহী। অল্প বয়সে বিয়েতে তার আগ্রহ নাই। পড়াশোনা শেষের আগে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলছি।’
সাজেদার সঙ্গে কথা বলার সময় পুকুর পারে পরিচর্যা কাজ করছিলেন তার শ্বশুর নুর ইসলাম ও শাশুড়ি শাহিদা বেগম। তাদের চোখে মুখেও পরিতৃপ্তির ছায়া।
নুর ইসলাম বলেন, ‘মাছ বেচাই খাই। হামরা সবজি কিনি না। খাওয়ার পরও বেচাই। এই টাকায় সংসার খরচ চলে। নাতি নাতনির লেখাপড়ার খরচ দেই। নাতনিক বিয়া দেওয়ার চিন্তা বাদ দিছি। আল্লায় দেয় এখন সবাই ভালো আছি।’
সাজেদার এমন ঘুরে দাঁড়ানো এবং মেয়েকে সম্ভাব্য বাল্যবিয়ের ঝুঁকিমুক্ত করার পেছনে সহায়ক শক্তি ছিল প্লান ইন্টারন্যাশনাল ও আরডিআরএসের সিএনবি প্রকল্প। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বাল্যবিয়ের কারণ চিহ্নিত করে তা নিরসন করা। ২০২১ সালের বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত প্রকল্পের তথ্য মতে কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু পরিবারের সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। যার প্রায় সব পরিবারের প্রধান সমস্যা দরিদ্রতা। এ ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব ও কিশোরীদের পড়াশোনার বিরতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে পরিবারগুলো বাল্যবিয়ে দেয়।
সিএনবি প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কুড়িগ্রাম বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ জেলা। এখানে বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ দরিদ্রতা। সাজেদার মতো হাজারো পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পে এমন এক হাজার ২০০ পরিবারকে আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্যবিয়ে না দেন। এতে করে ওই পরিবারগুলো আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে দরিদ্রতা জয় করছে। মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালু রাখছে, অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকছে।’
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫