|
প্রিন্টের সময়কালঃ ১২ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০১ পূর্বাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ২৯ মে ২০২৩ ০৬:১১ অপরাহ্ণ

রহস্যময় পাতালকালী


রহস্যময় পাতালকালী


দেশের ঐতিহ্যবাহী দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর পোলাপানদের মাথায় ভ্রমণ বলতেই প্রথম পছন্দ দুর্গম অঞ্চল। এ সংগঠনের ভ্রমণ সদস্যরা বয়সের তুলনায় নিজেদেরকে ষোল-সতেরো বছরের কিশোর ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সেই ভাবা থেকেই দুরন্ত দুর্বার দামাল কিশোরদের মতো চষে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার দুর্গম প্রান্তর। তেমনি এক জায়গা চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন পাতালকালী। এর পাশেই রয়েছে বহুল পরিচিত চন্দ্রনাথ পাহাড়। যেখানে সববয়সী ভ্রমণ পিপাসুদের রয়েছে যাতায়াত।

কিন্তু আমরা তো জীবনবাজী রাখা ভ্রমণপিপাসু। তাই তো চন্দ্রনাথে উঠার আগেই সিএনজি স্ট্যান্ডের ঠিক বাম পাশ দিয়েই ঢুকে যাই জংলি পথে। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোথাও পথটা এত সরু যে, বাঁক নেওয়ার পরে পেছনে থাকা সঙ্গীকেও দেখা যায় না। ভ্রমণে এরকম পথগুলো বেশ টানে। টানতে টানতে আমলকি বাগানের নীচে। দু-চারটা আমলকি চিবিয়ে খাই। আর নিজেরা বলাবলি করি, কার গাছের আমলকি না জিগাইয়াই খাই। এর জন্য না আবার হাশরের ময়দানে কঠিন জেরার মুখোমুখি হই। এরমধ্যে কেউ কেউ বলে উঠে আরে খান তো ভাই আগে। পরেরটা পরে দেখা যাইব। কিন্তু আমার মন সায় দেয় না। তাই গাছতলায় জিরানো বাদ দিয়ে সামনে আগাই। আগাতে আগাতে ধপ করে বসে যাই পাহাড় চূড়ায় বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বট বৃক্ষের তলায়। ডানে উঁচু পাহাড়। বামে গভীর গিরিখাদ। পেছনে বঙ্গোপসাগর। ওখান থেকে সাগরের নোনা জলের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ায়। ঠিক কতটা উঁচুতে ছিলাম তা জানা নেই। তবে মাথার কাছাকাছি থাকা নীল আসমানটা দেখে আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে কম করে হলেও আটশত ফিট উপরে হবে হয়তো। বসা থেকে উঠি এবার। বেশি জিরাইলে শরীর নেতিয়ে পড়ে। তাই হালকা পাতলা খাবার পেটে পুরে সামনে আগাই।

এবারের পথটা যেন আরও বেশি রোমাঞ্চকর। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাইকিং-ট্র্যাকিং। কখনো কখনো হাইকিং করার পথটা এতটাই সরু যে, একটু এদিক সেদিক হলেই সোজা নীচে পড়ে বড়া বাঁশের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চিকন বাঁশের উপরে গিয়ে বিঁধতে হবে। আহ!  ভাবতেই বেশ মনের মাঝে আনন্দ খেলে। যত্তসব উদ্ভট পাগলামো ভাবনা। আসলে মূল ব্যাপারটাও তাই। ভ্রমণে গিয়ে অজানাকে জানা হয়। অচেনা পথ চেনা। নতুন কোনো  অভিজ্ঞতা মিলে। এসব অর্জনের জন্য ভ্রমণ পাগলা হবার কোনো বিকল্প নেই। ভ্রমণে বের হতে হয় নানা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। ভ্রমণ হতে ফেরার পর তা যদি আমৃত্যু রোমঞ্চকর স্মৃতিচারণ না হতে পারে, তাহলে আর সেটা কিসের ভ্রমণ। দে-ছুটের দামালরা বুক চেতিয়ে বীর দর্পে জঙ্গলাকীর্ণ পথে আগাতে আগাতে একটা সময় পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল উঁচু পাহাড়টা হতে অনেকখানি পথ নীচে নেমে এসেছি।


খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে মুখে চকলেট পুরে আবারো হাইকিং শুরু। এবার শুধু নীচের দিকেই নামছি। নামতে নামতে হঠাত্ করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি আমরা যেন রয়েছি সবুজে ঘেরা কোনো কূপে। পাতালকালী পৌঁছার কিছুটা সময় আগেই এরকম দৃশ্যের  অবতারণা হবে। জায়গাটা চারদিক পাহাড়বেষ্টিত। ঘনসবুজ অরণ্যে ঘেরা। এরকম নয়ন জুড়ানো দৃশ্য দেখে, পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের ক্লান্তিটা নিমিষেই যেন উবে গেল। পাহাড়-জঙ্গলে ভ্রমণের তৃপ্তিটা ঠিক এরকম দৃশ্যপটের মাঝেই লুক্কায়িত। যা খুঁজে নিতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ নানা ভঙ্গিমায় ফটোশুট চলে। কারণ কোনো একসময় ভ্রমণকালে তোলা ছবিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতিপটে। যা দেখে হয়তো আপনি একাকি হেসে উঠবেন। যাই এবার আগাই।

পাতালকালী যে খুব কাছাকাছি তা আর বুঝতে বাকি রইল না। কারণ ডানে-বামে থাকা পাহাড়ের উপরে মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট মন্দিরের দেখা পাচ্ছি। কিন্তু একি হায়, সাপেরতো দেখা পাচ্ছি না! আসার আগে জানতে পেরেছিলাম, এপাশটায় থাকা মন্দিরগুলোতে সাপের বিচরণ রয়েছে বেশ। হতাশ মনে কিছুক্ষণ হাইকিং করার পরেই পাতালকালীর দেখা পাই। জায়গাটা পাহাড়বেষ্টিত ঝিরির পাশে। খাদের কিনারাও বলা যেতে পারে। বিশাল এক পাথরখণ্ড রয়েছে। দেখতে কালো। লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা পাথরের পাশে বসে একজন পুরোহিত পূজায় লিপ্ত। সনাতন ধর্মাবলম্বী ধার্মিকদেরও পদচারণা রয়েছে। জায়গাটকে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ উল্টা কালী নামেও চেনে জানে। লোকমুখে প্রচলিত আছে একসময় এখানে মানুষ বলি দেওয়া হতো। ঘটনার সত্যতা ও আরও নির্ভরযোগ্য তথ্য জানার আগ্রহ থেকে পুরোহিতের নিকট ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম। কিন্তু তার প্রশ্ন ছিল আমি হিন্দু কি-না। মুসলিম বলাতে উনি বারণ করলেন। আমিও আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করিনি। পরিবেশটায় গা ছমছম করছে। পাঠা বলি দেওয়ার উপকরণ দৃশ্যমান। এরপর ঠিক লাল কাপড়ে ঘেরা পাথরখণ্ডের পাশ দিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকি। কিছুদূর যাবার পরেই চোখ ছানাবড়া। জংলি গাছের ভিড়ে দিনের আলো চোর-পুলিশ খেলছে। আঁকাবাঁকা 


ছুটে-চলা ঝিরিতে সারি সারি পাথর। সেসব বড় বড় পাথরের ফাঁক গলে গড়িয়ে যাওয়া পানির কলকল শব্দ। বাতাসে গাছের পাতা ও ঝিরিতে পানির শব্দ মিলেমিশে এক অপার্থিব পরিবেশ।

দে-ছুটের ভ্রমণ পাগল দামালরা মনের আনন্দে যেতে থাকি। যেতে যেতে চোখে পড়ে লালসালু দিয়ে ঘেরা শিবলিঙ্গ (হিন্দুদের আখ্যায়িত) পাথর। বিশালাকার কালো পাথরটার প্রাকৃতিক অবয়ব বেশ চমত্কার। পর্যটকরা তা দেখে পুলকিত হবে নিশ্চিত। পাথরটা ঘিরে চলে কিছুক্ষণ ফটোসেশন। এরপর আরও কিছুটা সময় হাইকিং। ঝিরিটা চলে গেছে সোজা নাক বরাবর। ঝিরির নান্দনিকতায় লোভে পড়ে গেলাম। তখন কেউ একজন সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতে হবে কথাটা মনে করিয়ে দিল। আসলে কিছু কিছু দুর্গম জায়গায় ভ্রমণকালীন জন্তু জানোয়ারের ভয়ে নয়, মানুষের ভয়েই তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়। পাতালকালী অভিযানটাই শুরু করতে হয়েছে ডাকাতের আক্রমণের ব্যাপারটা মাথায় রেখে। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়। জঙ্গলে গেছি কিন্তু কারো ভয়ে লাকড়ি পুড়িয়ে রান্না করে খাব না—তা কী করে হয়। চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী সঙ্গে নেওয়া বাজার-সদাই সুবিধাজনক এক স্থানে চুলা বানিয়ে রান্না চড়িয়ে দেওয়া হলো। ঝিরির পানি ফ্রি। হাড়ি-পাতিল স্থানীয় গাইডের। থালা হিসেবে কলাপাতা। সব মিলিয়ে বরাবরের মতোই রেডি হয়ে যায় জম্পেশ খানাপিনা। খেয়েদেয়ে ফটিকছড়ির গভীর অরণ্যঘেরা পাহাড় দিয়ে ফেরার পথ ধরি। ফিরতি পথে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য পাতালকালী অভিযানকে করেছে ষোলকলা পূর্ণ।


চলেন যাই
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো পরিবহনে রাতের বাসে চড়ে ভোর পাঁচটা-ছয়টার মধ্যেই সীতাকুণ্ড। বাসস্ট্যান্ড হতে সিএনজি বা অটোতে চন্দ্রনাথ। সেখানকার দোকানদারদের সঙ্গে আলাপ করলেই মিলে যাবে স্থানীয় গাইড।

সময় ও খরচপাতি
ভোরে নেমে সারাদিন ঘুরে আবার ফেরা যাবে। খরচ  জনপ্রতি দেড় হাজার টাকা হলেই যথেষ্ট।

সতর্কতা
পেশাদার গাইড নাই। সেখানকার গাইড বলতে তারা স্থানীয় কৃষক, মজুর। সুতরাং নিজ নিজ নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজেরাই সতর্ক থাকুন। উনারা শুধুমাত্র পথপ্রদর্শক।
 
আরও যা দেখবেন
পাতালকালী হতে বিকালের মধ্যে ফিরতে পারলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া হতেও ঘুরে আসতে পারবেন।


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫