হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা করা। অর্থটি উল্লেখ করেছেন মুফতি শাফি (রহ.) তাঁর পবিত্র কোরআন তাফসিরে। (মাআরেফুল কোরআন, মদিনা, ১৩৮৪ হিজরি, পৃষ্ঠা ১৯০)
তবে হজ বলতে প্রধানভাবে বোঝায়, মিনা নামক স্থানে অবস্থান, আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি, মুজদালিফা চত্বরে রাত কাটানো এবং কাবাঘর তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করাকে। এগুলো পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা।
এ ছাড়া হজ সম্পর্কে রসুলে পাক (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্য ও তাঁর অনুশীলনগুলোও হজের অংশ হয়ে আছে।
সাধারণভাবে হিজরি সালের জিলহজ মাসের ৯ তারিখে এবং এর আগে-পরে নির্দিষ্ট স্থানে ইহরাম বেঁধে সমন্বিত আমল করাই হজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা হজকে মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য করে দিয়েছেন, ‘মানুষের মধ্যে যার মক্কায় যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশে কাবাঘরে হজ করা তার জন্য ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ৯৭)
এ ছাড়া নবী ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ জারি হয়েছিল এভাবে—‘মানুষের কাছে হজ ঘোষণা করে দিন...।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৭)
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি যখন আল্লাহর কাছ থেকে ‘হজ’ ঘোষণার তাগিদ এলো, তখন নবী খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। ইবরাহিম (আ.) তাই আল্লাহর কাছে সুস্পষ্টভাবে জানতে চান, ‘আমার ঘোষণা মানুষের কাছে কেমন করে পৌঁছে যাবে।’ আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, ‘হজের ঘোষণা দেওয়া আপনার কাজ, মানুষের কাছে এ ঘোষণা পৌঁছে দেওয়া আমার কাজ।’
ইবরাহিম (আ.) চকিত থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং পাহাড়ের ওপর থেকে অনেকটা আজানের মতো দুই কানে আঙুল রেখে বলে উঠলেন, ‘হে মানবজাতি, আল্লাহ তোমাদের জন্য এক ঘর তৈরি করেছেন, এ ঘরে হজ করা তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন। অতএব তোমরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও।’
এভাবে ইবরাহিম (আ.) মানবজাতির কাছে প্রথম হজের দাওয়াত দেন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি রুহের কাছে এ দাওয়াত পৌঁছে দেন। বলা হয়ে থাকে, যে যতবার এতে সাড়া দিয়েছে, সে ততবার হজ করেছে অথবা করবে। পাঁচ হাজার বছর পূর্ব থেকে এভাবে মুসলিম জাতি হজব্রত পালন করে আসছে।
ইবরাহিম (আ.) হজের জন্য যে দাওয়াত দিয়েছিলেন, তাতে প্রথম সাড়া দিয়েছিল ইয়েমেনবাসী। তাফসিরকাররা বলেছেন, ইয়েমেনের লোকেরা এ জন্য এখনো সবচেয়ে বেশি হজ করে। (মাওলানা আমিনুল ইসলাম : তাফসিরে নূরুল কোরআন, আল বালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৪৩)
সর্বশেষ হজের দাওয়াত দেন মোহাম্মদ (সা.)। বিদায় হজের দিনের ভাষণে নবী (সা.) বলেন, ‘হে লোক সকল, তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করা হয়েছে, তোমরা হজ করো।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩১৪৮)
তবে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির প্রতি শর্তাধীনে কাবাগৃহের হজ ফরজ করেছেন। শর্ত এই মক্কা পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য থাকতে হবে। সামর্থ্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে সাংসারিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ পরিমাণ অর্থ থাকতে হবে, যা দ্বারা সে কাবাঘর পর্যন্ত যাতায়াত ও সেখানে অবস্থানের ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া হজ শেষে নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণেরও ব্যবস্থা করে যেতে হবে। দৈহিক ও শারীরিক দিক দিয়েও সক্ষম হতে হবে অর্থাৎ হাত-পা ও চোখ কর্মক্ষম হতে হবে। কারণ যাদের এসব অঙ্গ অক্ষম তার পক্ষে নিজ দায়িত্বে হজ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় হজে যাওয়া ও হজের অনুষ্ঠানাদি পালন করা তার পক্ষে কষ্টকর হবে।
নারীদের পক্ষে মাহরাম ব্যক্তি ছাড়া সফর করা শরিয়ত বিচারে নাজায়েজ। কাজেই নারীদের সামর্থ্য তখনই হবে, যখন তার সঙ্গে কোনো মাহরাম পুরুষ হজে থাকবে। এমনিভাবে কাবাঘরে পৌঁছার জন্য রাস্তা নিরাপদ হওয়াও সামর্থ্যের একটি অংশ। যদি রাস্তা বিপজ্জনক হয় এবং জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে হজের সামর্থ্য নেই বলে মনে করা হবে। [মুফতি শাফি (রহ. মারেফুল কোরআন, মদিনা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০]
তাফসির ইবনে কাসির কিতাবে উল্লিখিত হয়েছে, ‘সামর্থ্যবান মানুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)
আর সুরা হজের একটি আয়াতে (তারা হজে আসবে হেঁটে অথবা সবচেয়ে দুর্বল উটের পিঠে চড়ে) তাফসির করতে গিয়ে ইবনে কাসির পূর্ববর্তী আলেমদের দলিল গ্রহণ করে লিখেছেন, এ আয়াতের দ্বারা বোঝা যায়, যে পারে সে যেন পায়দল হজ করে। পায়দল হজ বাহনে চড়ে হজ করার চেয়ে উত্তম। (ইবনে কাসির : সুরা হজের ২৭ নম্বর আয়াতের তাফসির)
হজ যদিও সামর্থ্যবানদের (সেটা অর্থ-সম্পদের দিক থেকে হোক বা শারীরিক দিক থেকেই হোক) জন্যই ফরজ করা হয়েছে; কিন্তু সম্পদের দিক থেকে সামর্থ্য নেই—এমন লোকও প্রতিবছর হজ করেন। অনেক ধনী লোক আছেন, যাঁদের অর্থ সম্পদ আছে; কিন্তু হজ করতে পারেননি। আবার অনেক সাধারণ মানুষ আছেন, যাঁরা দিন আনে, দিন খায়, তারা অনেকেই আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে হজ করে এসেছেন। তাঁদের সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়।
হজে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যা থাকে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। এরা সারা বছরই দলে দলে ওমরাহ করে থাকে এবং সুযোগ খুঁজে নেয় হজ করার। অনেক ধনবান লোকও আছেন, যাঁরা প্রতিবছর কিছু না কিছু গরিব ও নিঃস্ব মানুষকে নিয়ে যায় হজ করার জন্য। বিভিন্ন হজ সংস্থা ‘গাইড’ হিসেবে নির্বাচিত করে আলেমদের। এ আলেমদের অনেকেই অর্থ-সামর্থ্যের দিক থেকে দুর্বল প্রকৃতির। প্রতিবছর হজে অংশ নেওয়ার সংখ্যায় তাদের উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। এ ছাড়া মক্কা-মদিনায় হজের আনুষ্ঠানিকতায় জড়িত থাকে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষও। এ সংখ্যাও লক্ষাধিক।
দুনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা হজ করেন, তাঁদের বয়স বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বার্ধক্য-পরিণতির। কিন্তু অধিকাংশ দেশ থেকে হজ করতে যাঁরা আসেন তাঁদের মধ্যে তরুণ এবং যুবকরাই প্রধান। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার হাজিদের মধ্যে বেশির ভাগ থাকে অবিবাহিত যুবক, যাদের বিয়ের শর্তের মধ্যে ‘হাজি’ হয়েছেন কি না যাচাই করা হয়ে থাকে। ফলে এসব অঞ্চলের যুবকরা বিয়ের আগেই হজ করে নেন।
হজের সর্বজনীনতা আরো স্ফুটিত হয়ে ওঠে, যখন দুনিয়ার বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ একত্র হয়। একটি দেশের নানা রকম জাতি হজে এসে উপস্থিত হয়, তখন হজ হয়ে ওঠে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘জাতিসংঘ’। বর্তমানে জাতিসংঘ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, তা আসলে রাষ্ট্রসংঘ বা দেশসংঘ। দুনিয়ার সকল জাতির প্রতিনিধিত্ব এখানে নেই। একটি দেশে অনেক জাতির বাস থাকে, একমাত্র হজেই এই সব জাতির প্রতিনিধিত্ব থাকে। যেমন কুর্দিরা একটা জাতি। কিন্তু এ জাতি সিরিয়া, ইরাক, তুর্কি এবং কিছু স্বশাসিত অঞ্চল দ্বারা বিভক্ত হয়ে আছে। কিন্তু হজে স্বাধীন-পরাধীন সব কুর্দিই মক্কায় এসে হাজির হয়। দুনিয়ায় অনেক জাতি আছে যাদের জাতিসত্তাকেন্দ্রিক দেশ নেই। হজে সেসব জাতিও এসে শামিল হয়।
হজের গুরুত্বপূর্ণ সর্বজনীনতা হচ্ছে সমগ্র দুনিয়ার আলেম ও ইসলামী পণ্ডিতদের একত্র হওয়া। মুসলমানদের ঈমান ও আমলের উন্নতি বিধায় নানা রকম কর্মপদ্ধতি চিন্তার সুযোগ ঘটায় এ মহাসমাবেশ। ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে একতা ও সম্পর্ক বৃদ্ধির নানা রপকল্পও এ সময় প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ-আমির, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান-সরকারপ্রধান যাঁরাই এতে অংশ নিন না কেন, প্রজা আর রাজার পোশাকে কোনো ব্যবধান থাকে না। সবার পরনেই থাকে কাফনের কাপড় সদৃশ পোশাক। চুল থাকে এলোমেলো, মুখ উষ্কখুষ্ক। মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফার মাঠে সবাইকে একত্রে মাটিতেই থাকতে হয়। সবাই এক হয়ে শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারে। একত্রে সবাই কাবাঘর প্রদক্ষিণ করে, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ওঠা-নামা করে পাশাপাশি থেকে এক হয়ে এক সঙ্গে। বড়-ছোট হয়ে যায়, ছোট-বড় হয় হজের মহিমায়।
তবে হজের প্রধান কাজ হলো, আরাফাতের ময়দানে হাজিরা দেওয়া। কেউ যদি হজ করতে গিয়ে কোনো কারণে আরাফাতের ময়দানে অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তিনি হাজি হতে পারবেন না। শাব্দিকভাবে আরাফাতের অর্থ হলো ‘পরিচয়’। আদম (আ.) এবং তাঁর স্ত্রী যখন জান্নাত থেকে দুনিয়াতে প্রেরিত হলেন, তখন তাদের নতুন করে পরিচয় হয়েছিল আরাফাতের ময়দানে। আদম (আ.) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় অবতরণ করেছিলেন শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড়ে, আর হাওয়া (আ.) অবতরণ করেছিলেন জেদ্দায়। দীর্ঘদিন সাধনার পর দুজনের দেখা হয়, আরাফাতের ময়দানে। দুজন দুজনকে চিনলেন না। আদম (আ.) হাওয়া (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জবাব এলো, ‘আমি হাওয়া, একজন জীবিত মানুষ থেকে আমাকে তৈরি করা হয়েছে। তাই আমার নাম হাওয়া। এবার হাওয়া (আ.) পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি কে? জবাব এলো,আমি আদম। জমিনের মাটি থেকে আমাকে তৈরি করা হয়েছে, তাই আমার নাম আদম।’ (তাফসিরে নূরুল কোরআন, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮-১৯৯)
এভাবে দুজন দুজনের পরিচয় জানলেন। পরিচয় জানার পর এ স্থানের তাই নাম হলো ‘আরাফাত’। আরাফাতের ময়দানে হাজিরা দিয়ে হাজিকে তাই পরিচিত হতে হয়। তা না হলে সে ‘হাজি’ হতে পারে না। হজের সার্বিক কার্যক্রমের এ অংশটি সর্বজনীন হজের প্রাণভ্রমরা।