বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এক হার না মানা মা

প্রকাশকালঃ ১২ মে ২০২৪ ১২:১৫ অপরাহ্ণ ৬২০ বার পঠিত
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এক হার না মানা মা

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-

 

প্রতিটি মায়ের মধ্যেই একজন হার না মানা যোদ্ধা বাস করেন, যিনি সন্তানের জন্য অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তেমনই একজন হার না মানা যোদ্ধা রিকতা আখতার বানু। তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে যখন কোনো সাধারণ স্কুলে পড়াতে পারছিলেন না, তখন তিনি তার মেয়ে ও তার মেয়ের মতো অন্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন বিশেষায়িত শিক্ষায়তন।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রিকতা আখতার বানু পেশায় একজন সেবাকর্মী, দাপ্তরিক পদবি সিনিয়র স্টাফ নার্স। তার কোলে যখন মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণি এলো তখন সব মায়ের মতো তার মনও খুশিতে ভরে উঠেছিল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তার আদরের ধন নয়নের মণি তানভীন দৃষ্টিমণি আর দশটা সাধারণ শিশুর মতো নয়, সে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। তার জন্য দরকার আলাদা মনোযোগ, সেবা ও প্রশিক্ষণ। চিলমারীর মতো প্রত্যন্ত এলাকায় যা পাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতা বুঝতে পারলেও হতাশ হননি। নিজের মেয়েকে নিজেই যতটুকু সম্ভব সেবাযত্ন ও দেখভালের চেষ্টা করেছেন। যে বয়সে সব শিশু স্কুলে যায় মনির ইচ্ছা করত সবার সঙ্গে স্কুলে যেতে, রিকতা আখতারও চাইতেন মনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে, অন্যদের সঙ্গে স্কুলে যাবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে তাকে স্কুলেও ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু স্কুল মনির জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। অন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ছিল না এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর প্রতি সদয়। সেখানে তাকে শিকার হতে হয় হাসি-ঠাট্টার। একপর্যায়ে, মা রিকতা আখতারকে ডেকে জানিয়ে দেন তার ‘মনি’কে স্কুলে রাখা সম্ভব না। মনের দুঃখ মনে চেপে মেয়ের হাত ধরে সেদিন স্কুল থেকে চলে এসেছিলেন বটে, কিন্তু মেয়েকে স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন ছাড়েননি। তিনি অনুভব করেছিলেন এই সংকট তার একার নয়, আরও হাজারো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর অভিভাবকেরও। এই সমস্যা সমাধানে তিনি স্থির করলেন তার ‘মনি’র মতো হাজারো মনির জন্য গড়বেন এক বিশেষায়িত স্কুল, যেখান থেকে আর কোনো মনিকে বের করে দেওয়া হবে না বরং আদরে, হাসিতে পড়বে, খেলবে এই নয়নমণিরা। 

 

আজ থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে এভাবেই যাত্রা শুরু করেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। মেয়ের জন্য স্কুল তৈরি করে সেই স্কুলে ভর্তি করান মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণিকে। এই বিশেষায়িত স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পরে অন্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অভিভাবকরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।

 

‘প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই স্বজন, এদের সহানুভূতি নয়, সহযোগিতা করুন’ কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা এলাকার গেটে এই বাক্য দেখলেই মনে হবে প্রতিবন্ধী সন্তানদের জন্য কতটা ভালোবাসা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিদ্যালয়টি। গেট পেরিয়ে ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য প্রতিবন্ধী শিশুর। শিশুদের একত্রিত করে পিটি প্যারেড করাচ্ছেন শিক্ষকরা। এরপর বিদ্যালয়ের রুমে রুমে চলছে ক্লাস। শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য চলে নাচ-গান আর ছড়া-কবিতা। অনেক অভিভাবক স্কুল ছুটির পর অপেক্ষায় রয়েছেন সন্তানের।

 

স্থানীয় অধিবাসীরাও স্কুলটিকে আপন করে নিয়েছেন। তারাও অনুভব করছেন, এই বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুরা আসতে পারলে অনেক খুশি হয়। বাড়িতে রাখার চেয়ে বিদ্যালয়ে নিয়ে এলে তাদের মানসিক উন্নয়ন ঘটছে। অনেক শিশু এখান থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযোগী হয়েছে।

 

লাভলী বেগমের সন্তান এই বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে। তিনি বলেন, আমার সন্তান ৯ বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারেনি। খুব দুশ্চিতায় ছিলাম। এখানে (রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়) ভর্তি করার পর সে এখন কথা বলে। আগে আমি নিজেই তাকে স্কুলে নিয়ে আসতাম। এখন আর নিয়ে আসাও লাগে না। সে এখন একা একাই স্কুলে আসে।

 

মেনেকা বেগম নামের আরও এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ের নাম সাদিয়া সুলতানা। বয়স প্রায় ৯ বছর। অন্য স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করাতে গিয়েছিলাম। ভর্তি নেয়নি। পরে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে এখানে ভর্তি করিয়েছি। স্কুলের গাড়ি বাড়ি থেকে বাচ্চাকে নিয়ে আসে। আবার স্কুল শেষ হলে গাড়িতেই আবার বাড়িতে রেখে যায়। স্কুলের সময়টা আমি দুশ্চিতা মুক্ত থাকি। এই স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে পেরে আমার অনেক

 

উপকার হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নেই সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেছেন। ২০২০ সালে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। ১৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। আর শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ জন। স্কুলটিতে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১০ জনের বেতন-ভাতা এমপিওভুক্তির কারণে হলেও বাকিরা এখনো আসতে পারেননি সরকারি বেতন-ভাতার আওতায়।


রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহিন শাহ বলেন, আমাদের স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে, যানবাহনে (ভ্যান), থেরাপি রুম ও ক্রীড়া সামগ্রীর সমস্যা আছে। আমরা শিক্ষক, কর্মচারী, স্থানীয় লোকজন ও প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির সহায়তায় বাচ্চাদের দুপুরে নাশতা দিয়ে থাকি। সরকার যদি আমার স্কুলটিতে দুপুরের নাশতার ব্যবস্থাটা করত তাহলে হয়তো বাচ্চারা অনেক উৎসাহ পেত। আমরা বাচ্চাদের নিজের সন্তানের মতো দেখি এবং তাদের নিয়ে চলাফেরা করি।

 

স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বিদ্যালয়ের ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১০ জনের বেতন-ভাতা হলেও বাকিরা এখনো আসতে পারেননি বেতন-ভাতার আওতায়। এ কারণে বাকিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব শিক্ষক-কর্মচারী বেতন ভাতার আওতায় এলে শিক্ষার্থীদের অনেক যতœসহকারে পাঠদান করাতে পারবেন।

 

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স, রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বলেন, এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে অনেক ব্যথার কথা আছে। আমার মেয়েকে যখন সাধারণ স্কুলে দিয়েছিলাম তখন তারা আমার মেয়েকে বের করে দিয়েছে। প্রতিবন্ধী বলে তাকে কটুকথা বলেছে। পাগল-পাগলি বলত। এরপর আর কোথাও ভর্তি করাতে পারিনি তাকে। এ জন্য মনে অনেক ব্যথা ছিল। সেই ব্যথার দান এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে স্কুলের বিভিন্ন রকমের সমস্যা আছে। আর বাকি শিক্ষক-কর্মচারীকে যদি সরকার বেতন-ভাতার আওতায় নিয়ে আসত তাহলে অনেক ভালো হতো। যে মেয়ের উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠান করেছি সেই মেয়ে এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ। আমার মেয়ে স্কুলে এলে স্কুল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে স্কুল থেকে যেতে চায় না। আর সে এত আনন্দে থাকে তা দেখে আমার মন ভরে যায়। একটা কথা কি জানেন, প্রতিবন্ধী সন্তানকে সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পড়াতে না চাওয়া ও অপমানের কষ্ট একমাত্র মা-বাবা ছাড়া আর অন্য কেউ বুঝতে পারার কথা নয়। অন্য প্রতিবন্ধী সন্তানের মা-বাবার কথা আমার থেকে আর কে ভালো বুঝবে। তাদের সবার কথা ভেবেই এই বিশেষায়িত বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলাম।
 

রিকতা আখতার বানু এখনো চাকরি থেকে অবসর  নেননি। কিন্তু তিনি এখন অনেকটাই অসুস্থ। বাকি জীবন কাটাতে চান তার বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে। নিজের মেয়েসহ অন্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই হার না মানা মা।