|
প্রিন্টের সময়কালঃ ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৩:১৩ অপরাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১২:৫০ অপরাহ্ণ

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ও কাব্যচিন্তা


রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ও কাব্যচিন্তা


নিউজ ডেস্ক-ঢাকা প্রেস


 

কবি মূলত একজন সাধারণ মানুষ। রাজা, রানি কিংবা রূপকথার রাজকুমার নন তিনি। রাষ্ট্রপতির পদেও অধিষ্ঠিত হলেও তাঁর ভেতরে থাকে এক সাধারণ মানুষের অনুভব—বিপন্ন হলে তাঁর চোখেও জল ঝরে। ইতিহাসে এমন বহু কবি-রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ আছে, যারা ছিলেন মানুষের প্রতি নিবেদিত। সেনেগালের রাষ্ট্রপতি ও কবি লিউপোল্ড সেদার সেঙর, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কিংবা বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট আলিয়া ইজেতবেগোভিচ এর অনন্য দৃষ্টান্ত। এমনকি বিশ্বপরিবর্তনকারী ব্যক্তিত্ব কার্ল মার্কস, মাও সেতুং বা স্টালিনও লিখেছেন কবিতা। যে স্টালিনের নামে নামকরণ করা হয়েছে রেজাউদ্দিনের নাম।
 

আমরা আজ এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যা গভীর নিঃসঙ্গতার সময়। অথচ মানুষ স্বভাবতই নিঃসঙ্গ থাকতে চায় না। সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা ক্রমশ যেন বলছে—‘একা হও’। এই নির্দেশ মানবসভ্যতার মৌলিক স্বরূপের পরিপন্থী।
 

বিশ্ব এখন দুই মহামারিতে বিপর্যস্ত—একদিকে করোনায় মৃত্যু, অন্যদিকে ক্ষুধায় মৃত্যু। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মিনিটে অন্তত ১৫ জন মানুষের প্রাণ হারাচ্ছে ক্ষুধায়। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভারত, বাংলাদেশসহ বহু দেশ।
 

আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যেন পুঁজিবাদী বিশ্বের ভিতরকার শূন্যতা প্রকাশ করে দিয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন এসেছে, কিন্তু বর্ণবৈষম্যের ভ্যাকসিন কি কখনও আসবে? এই প্রশ্ন যেমন আমাকে ভাবায়, তেমনি ভাবায় রেজাউদ্দিন স্টালিনকেও। তাঁর কবিতা সেই মানবিক অনুরণনকে পুনরুজ্জীবিত করে।
 

রেজাউদ্দিন স্টালিনের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। বাংলাদেশের ঘটনার অভিঘাত যেমন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, তেমনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কোনো ঘটনা ঘটলে তাঁর মনে একইরকম অস্থিরতা জাগে। সেই অস্থিরতাই রূপ নেয় কবিতায়, ছবিতে বা গানে। আজকের বিশ্ব সবকিছু বিচার করে ‘টাইম অ্যান্ড স্পেস’—সময় ও প্রান্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে। পৃথিবী এই বিশাল সৌরপরিবারের ক্ষুদ্র অংশ, অথচ মানুষই তার কেন্দ্রবিন্দু। প্যারিস, কলকাতা, দিল্লি, নিউইয়র্ক বা তিব্বতে কোনো ঘটনা ঘটলে যেমন আমার অনুভূতি স্পন্দিত হয়, তেমনি হয় স্টালিনেরও।
 

তাঁর একটি কবিতা ‘সূচনাপর্ব’ এ এমন এক গভীর সময়চেতনা ধরা পড়ে—

আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত
মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা
আমার জন্ম কোনো সময়কে ইঙ্গিত করে না
এমন কি ঘটনাগুলো মুহূর্তের শৃঙ্খলমুক্ত
যখন পৃথিবীতে কিছুই ঘটছে না
তখন সময় কি জিজ্ঞাসাচিহ্নের মতো
থিতু
আমি কি শুধু মৃত্যুর ভয়ে সময়কে
শনাক্ত করতে চাই

 

এ এক মৌলিক জিজ্ঞাসা। এমন অনেক মৌলিক প্রশ্ন কবিতায় স্থাপন করেছেন স্টালিন, যা বাংলা কবিতার জন্য অপরিহার্য। তাঁর কবিতা সমানভাবে সমাদৃত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে।

তিনি প্রায় ৫০টিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কবিতাকে গভীরভাবে না ভালোবাসলে এতদূর আসা সম্ভব নয়। তাঁর ‘যারা তাদের হত্যা করেছিল ভালোবাসার সুযোগে’ কিংবা ‘দুঃখ’ শিরোনামের কবিতাগুলো গভীর অন্তর্গত অনুভূতি প্রকাশ করে। সেখানে যেমন লেখেন—

“সম্পাদক প্রতিবারই বললেন—
আপনার দুঃখ প্রসেসে আছে।”

 

বাস্তবেই প্রতিটি মানুষের দুঃখ যেন চিরকাল ‘প্রসেসে’ থাকে।
 

রেজাউদ্দিন স্টালিন মানবিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় দৃঢ়। সমাজের অসংগতি, অবিচার ও অন্যায় তাঁকে ব্যথিত করে, ক্ষুব্ধ করে। তবে তাঁর প্রতিবাদ সর্বদা শৈল্পিক ও আধুনিক।
 

আমি বিশ্বাস করি—কোনো ‘ইজম’ দিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা সৃষ্টি হয় না। প্রকৃত কবিতার জন্ম হয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস থেকে। সেই বিশ্বাস রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় প্রবাহিত।
 

একবার ফ্রান্সের একটি পাহাড়ি গুহাসদৃশ রেস্টুরেন্টে ছিলাম। সেখানে ঢাকায় জন্ম নেওয়া, পরে গ্রিসে ওয়েটারের কাজ করা এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—“আপনি কি রেজাউদ্দিন স্টালিনকে চেনেন?” হাজার মাইল দূরে থেকেও তাঁর নাম মানুষের মনে আছে—এটাই কবির প্রকৃত প্রাপ্তি।
 

তাঁর একটি কবিতায় এসেছে—

“জিজ্ঞেস করো না …
সময় কিভাবে থকথকে হলো ঘৃণায়।”

 

ঘৃণাকে এভাবে শব্দে ধারণ করা সত্যিই বিস্ময়কর। অলংকারবর্জিত, নির্ভার ভাষায় তিনি যে সত্য উচ্চারণ করেন, তা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে। তাঁর কবিতা পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে কবিতার সেতুবন্ধনেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
 

রেজাউদ্দিন স্টালিন আমাদের সময়ের এক জাগ্রত কবিতা-সৈনিক। বাংলা ভাষা ও কবিতার জয় হোক—এই কামনা জানাই। তাঁর কাব্যিক দায়বদ্ধতা আমাদের আশার আলো দেখায়।
 

জয় হোক বাংলা কবিতার। জয় হোক বাংলা ভাষার।


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫