মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহ তা‘আলার অতি আশ্চর্যময় সৃষ্টি। রূহ নামক একটি কুদরতি নির্দেশের মাধ্যমে তিনি মানব দেহকে সচল রাখেন। সেই দেহের উপর প্রভাব বিস্তারকারী অঙ্গ হলো ক্বলব। ক্বলব হলো মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। দেহ হচ্ছে ক্বলব এর আবরণ মাত্র। মানবজীবনে দেহের যেমন পরিচ্ছন্নতা ও পরিচর্যা প্রয়োজন তেমনি ক্বলবের রক্ষণাবেক্ষণও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ক্বলবকে বলা হয় দেহের রাজা। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ক্বলব হলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাদশা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো তার সৈন্য বাহিনী। বাদশা ভালো হলে তার সৈন্যবাহিনী ভাল হয়। আর সেনাবাহিনী তখনই খারাপ হবে যখন বাদশা খারাপ হয়ে যাবে।
এটি মানুষের হেদায়াতের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের নেক আমল আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ক্ববুল হওয়ার জন্য প্রয়োজন পরিশুদ্ধ ক্বলব। পরিশুদ্ধ ক্বলব ছাড়া সফলতা লাভ করা যেমন অসম্ভব ঠিক তেমনি সঠিক হেদায়াত লাভ করাও সম্ভব নয়। ক্বলবের অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَتَکُوۡنَ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ یَّعۡقِلُوۡنَ بِهَاۤ اَوۡ اٰذَانٌ یَّسۡمَعُوۡنَ بِهَا ۚ فَاِنَّهَا لَا تَعۡمَی الۡاَبۡصَارُ وَ لٰکِنۡ تَعۡمَی الۡقُلُوۡبُ الَّتِیۡ فِی الصُّدُوۡرِ . তরজমা: তারা কি যমীনে ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারত, আর তাদের কান শুনতে পারত। প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ নয়, বরং বুকের ভিতর যে হৃদয় আছে তা-ই অন্ধ। [সূরা হাজ্জ: ৪৬]
ক্বলব এর পরিচয়
‘ক্বলব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- হৃদয়, বুদ্ধি, প্রাণ। এছাড়া ক্বলব শব্দটি আরো কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, ১. পরিবর্তন। হাদিস শরীফে রয়েছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّمَا سُمِّيَ الْقَلْبُ مِنْ تَقَلُّبِهِ إِنَّمَا مَثَلُ الْقَلْبِ كَمَثَلِ رِيشَةٍ مُعَلَّقَةٍ فِي أَصْلِ شَجَرَةٍ يُقَلِّبُهَا الرِّيحُ ظَهْرًا لِبَطْنٍ
অর্থ: প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কলব নামকরণ হয়েছে তার পরিবর্তনের কারণে। ক্বলবের উপমা গাছের গোড়ায় আটকে যাওয়া একটি পালকের মতো, যাকে বাতাস পিঠের দিকটা পেটের দিক করে পরিবর্তন করে। [মুসনাদ আহমদ-১৯৬৬১, বায়হাকি- শুআবুল ঈমান-৭৫২]
২. উলট-পালট। মানুষের হৃদয় প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যায়, উলটপালট হয়। বিভিন্ন কারণে বিশ্বাস, চেতনা ও কল্পনার মধ্যে উলটপালট হয়। হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُكْثِرُ أَنْ يَقُولَ ” يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ ” . فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ آمَنَّا بِكَ وَبِمَا جِئْتَ بِهِ فَهَلْ تَخَافُ عَلَيْنَا قَالَ ” نَعَمْ إِنَّ الْقُلُوبَ بَيْنَ أَصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللَّهِ يُقَلِّبُهَا كَيْفَ يَشَاءُ ”
অর্থ: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই দু’আ অধিক পাঠ করতেন: হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত (দৃঢয়) রাখো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। আমরা ঈমান এনেছি আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তার উপর। আপনি আমাদের ব্যাপারে কি কোন রকম আশংকা করেন? তিনি বললেন- হ্যাঁ, কেননা, আল্লাহ তা‘আলার (কুদরতের) আঙ্গুলসমূহের মধ্যকার দুটি আঙ্গুলের মাঝে সমস্ত অন্তরই অবস্থিত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তা পরিবর্তন করেন। [তিরমিজি-২১৪০]
৩. খাঁটি বস্তু। কোন কিছুর খাঁটি ও সেরা অংশকে বলা হয় কলব। যেমন, আরবিতে খাঁটি বা উচ্চ বংশের লোক কে বলা হয় رجل قلب । আবার বলা হয,।جئتك بهذا الامر قلبا আমি তোমার নিকট শুধু মাত্র এই কাজের জন্য এসেছি। [বাংলা একাডেমি, আরবি বাংলা অভিধান ১৯৮৫/৩]
ক্বলবের সংজ্ঞায় বিশ্বখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মাহমুদ আলুছি বাগদাদি রাহমতুল্লাহি আলায়হি বলেন- ক্বলব বলা হয় আল্লাহ প্রদত্ত আলোকিত জ্ঞানী সত্তাকে, যা আল্লাহর নূর অবতরণের স্থল, এর দ্বারাই মানুষ নির্দেশ পালন ও নিষেধ বর্জনে সক্ষম হয়। মনীষীদের মতে এই কলবই হলো জ্ঞানের উৎস, ঈমানের কেন্দ্রস্থল ।
[তাফসিরে রুহুল মাআনি:১/ ২২০ ও ২২১]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, أَلاَ وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِىَ الْقَلْبُ.
অর্থ: জেনে রাখ! মানবদেহে এমন একটি ‘মুদগা’ রয়েছে, যা সুষ্ঠু হলে সমগ্র দেহ সুষ্ঠু হয়; আর তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; জেনে রাখ! তা হলো ‘ক্বলব’। (সহিহ বোখারি)। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্বলবকে ‘মুদ্বগাহ’ বা মাংসপিণ্ডের সাথে তুলনা করেছেন।
অভিধানে ‘মুদ্বগাহ’ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু চিবানো, লুকমা গ্রাস, উচ্ছিষ্টাংশ। অনেক সময় মাংস ছাড়া জিহ্বাকেও মুদ্বগাহ্ বলা হয়ে থাকে । আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অতঃপর আমি ‘আলাক’ কে ‘মুদ্বগাহ্’ পরিণত করলাম, তারপর ‘মুদ্বগাহ’-এ ‘ইয্মা’। [সূরা মোমিনুন : ১৪]
মানুষের হৃদয়
রক্তে মাংসে গড়া মানুষের দেহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা একটি অশরীরী নি’মাত দিয়েছেন। যাকে বলা হয় রূহ তথা আত্মা। এই রূহের প্রকৃত স্বরূপ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الرُّوۡحِ قُلِ الرُّوۡحُ مِنۡ اَمۡرِ رَبِّیۡ وَ مَاۤ اُوۡتِیۡتُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ اِلَّا قَلِیۡلًا
তরজমা: এবং আপনাকে কে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন, ‘রূহ আমার রবের আদেশ থেকে, আর তোমাদেরকে জ্ঞান থেকে অতি সামান্যই দেয়া হয়েছে’।
[সূরা বনী ইসরাইল:৮৫]
মায়ের পেটে সন্তানের ১২০ দিন হলে আল্লাহ তা‘আলা মাতৃগর্ভে রূহ বা আত্মা দান করেন। মানুষের আত্মার জগতের ক্ষেত্র বা পরিধি দৃশ্যমান জগতের চাইতে অনেক বড়। আত্মার জগতে মানুষ স্বাধীন। মানুষ তার প্রতিটি কাজ কি উদ্দেশ্যে সম্পাদন করছে এর সঠিক খবর আত্মার কাছেই থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহর বাহ্যিক অবয়ব দেখেননা, বরং তার ভিতরের সত্ত্বাকে দেখেন। পবিত্র হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ للهَ تَعَالَى لاَيَنْظُرُ إِلَى أَجْسَامِكُمْ وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلِكِنْ يَّنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের শরীর ও চেহারার দিকে দেখবেন না, বরং তিনি দেখবেন তোমাদের ক্বলব ও আমল বা কর্মের দিকে।
আত্মাই মানুষের সর্বাধিক আপন। ইহকালীন জগতে মানুষের গতিপ্রকৃতি, কাজকর্ম, চিন্তা চেতনা তথা বিস্তীর্ণ কর্ম জগতের সকল কর্মকান্ড আত্মার গতি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। মানবজাতির হেদায়তের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করে চারটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
তরজমা: অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। [সূরা আলে ইমরান: ১৬৪]
পবিত্র ক্বোরআনুল কারীমের উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নবুয়তের চারটি কর্তব্যের ক্রমবিন্যাস করে দিয়েছেন। এগুলো হলো:
১. আয়াতের তিলাওয়াত, ২. আত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন, ৩. কিতাব শিক্ষা দান ৪. হিকমত শিক্ষা দান।
উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বিষয়টি তথা আত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন কে আরবিতে ‘‘তাযকিয়া-ই নাসফ’’ বলা হয়। তাযকিয়া শব্দটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। পরিভাষায় তাযকিয়া বলা হয়:
التزكيه بمعنى التطهير والتنقيه من السوء والقبائح والمنكرات
অর্থ: দেহমনকে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, পাপাচার ও অপকর্ম থেকে পবিত্রকরণ ও পরিশুদ্ধকরণ। মানুষ সাধারণত বাহ্যিক ময়লা বা অপবিত্রতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকেন। কিন্তু অন্তরের ময়লা সম্পর্কে উদাসীন। এই অন্তরের উদাসীনতা দূর করার জন্য কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীর-মাশায়েখগণের কাছে গিয়ে বাইয়াত গ্রহণ করা। যেমনি ভাবে মহান আল্লাহ তা‘আলা নবুয়তের দায়িত্ব ঘোষণা করার ক্ষেত্রে আয়াতের তেলাওয়াত, আয়াত ও হিকমাহর শিক্ষাদানের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির কথাও উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি ইসলামের পূর্ণরূপ সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রয়োগ বিধি অর্জনের জন্য আধ্যাত্মিক শিক্ষকের অধীনে অনুশীলনের অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক।
আর সেটি অর্জিত হয় তরিকত চর্চা তথা আধ্যাত্মিক মহামনীষীদের সংস্পর্শের মাধ্যমে। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে একদা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম এসে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন। প্রথমটি হল ঈমান, দ্বিতীয়টি ইসলাম আর তৃতীয়টি হলো ইহসান সম্পর্কে। যেটিকে ‘‘হাদিসে জিবরাঈল’’ বলা হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন। এজন্য মুমিন জীবনে ঈমান ইসলামের পাশাপাশি ইহসান এর গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা ঈমান হলো বিশ্বাসের নাম, ইসলাম হল কর্মের নাম। ইহসান শব্দের অর্থ হলো সুন্দর করা, কোন কাজ নিষ্ঠার সাথে ও উত্তম রূপে সম্পাদন করা। পরিভাষায় ইহসান হলো জাহের ও বাতেন উভয়কে সংশোধন করা এবং খুশু-খুযু সহকারে আদবের সাথে আমল করা। ইমাম খাত্তাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইহসান বলতে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই উদ্দেশ্য। ইহসান হলো দ্বীনের আধ্যাত্মিক স্তম্ভ। অনেকে ইহসানকে ‘‘তাসাউফ’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাসাউফ অর্থ হলো পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। ইহসান সম্পর্কে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেছেন,
ان تعبد الله كانك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك
অর্থাৎ তুমি এমন ভাবে ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছো। যদি তুমি তাকে না-ও দেখো, তিনি তো তোমাকে দেখছেন । [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]
মানুষের আলোকিত দিক বা নূরানী অবয়বটা হল রুহের সাথে সম্পর্কিত এবং জৈবিক দিকটা হল নফসের সাথে সম্পৃক্ত। মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কোরআনে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا ، فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَ، قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ، وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
তরজমা: আর শপথ নফসের এবং তার যিনি তাকে সুঠাম করেছেন এরপর তাকে অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সফল হয় সেই ব্যক্তি যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ব্যর্থ হয় সে ব্যক্তি যে তার আত্মাকে কলুষিত করে। [সূরা আস-শামস: ৭-১০]
পবিত্র কুরআনের ভাষায় ক্বলব
পবিত্র কোরআনে ক্বলব বিষয়ে ১৩২ টি মতান্তরে ১৪৪টি আয়াত রয়েছে। সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে ক্বলবকে মুক্ত রাখা প্রতিটি মানুষের জন্য অতীব জরুরী। কারণ ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় ক্বলবের সুস্থতা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা ও নফসে আম্মারার কারণে মানুষের ক্বলব অপবিত্র হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللَّهِ ۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
তরজমা: তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? [সূরা জাসিয়া:২৩]
মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে পৃথক হতে পারবেনা যতদিন জীবন থাকবে ততদিন তার প্রবৃত্তিও থাকবে। এজন্য ইসলামী শরীয়তে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন,
وَ مَاۤ اُبَرِّیٴُ نَفۡسِیۡ ۚ اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۵۳﴾
তরজমা: ‘আর আমি আমার নাফ্সকে পবিত্র মনে করি না, নিশ্চয় নাফ্স মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। [সূরা ইউসুফ: ৫৩]
ক্বলবের পরিচর্যা
মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে পৃথক হতে পারবেনা যতদিন জীবন থাকবে ততদিন তার প্রবৃত্তিও থাকবে এজন্য ইসলামী শরীয়তে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ শিরক, কুফর, রিয়া, গিবত, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, ঈর্ষা, কৃপণতা, গর্ব-অহংকার, দুনিয়ার মোহ ও নেতৃত্বের লোভ, আত্মসাত ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ে। এগুলোই রোগাক্রান্ত ক্বলবের নমুনা। এসকল মন্দ চরিত্রের কারণেই অন্তরের প্রশান্তি লোপ পায়। হৃদয়টা প্রশান্তিহীন অস্থির হয়ে পড়ে। এই প্রশান্তিহীন হৃদয়, অস্থির আত্মা থেকে প্রশান্তি পাওয়া এবং প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকার উপায় হলো আল্লাহর জিকিরে নিয়োজিত থাকা, আল্লাহর ক্বোরআন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে শক্ত করে আঁকড়ে থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ
তরজমা: ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’। [সূরা রা’দ: ২৮]
আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
তরজমা: ‘হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।’ [সূরা: ইউনুস-৫৭]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ : ( كلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ) ”
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দাহ যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। অতঃপর যখন সে গুনাহর কাজ পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তওবা করে তার অন্তর তখন পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা আল্লাহ তা‘আলা যার বর্ণনা করেছেনঃ “কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে জং (মরিচা) ধরিয়েছে।’’ [সূরা মুতাফফিফীন-১৪, তিরমিজি-৩৩৩৪]
আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আল্লাহকে ভয় করা, হালাল হারাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, যাবতীয় পাপকাজ থেকে দূরে থাকা, সর্বদা পরকালের কথা স্মরণ করা,ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়া, আত্মসমালোচনা করা, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা, দরুদ শরীফ পাঠ করা ইত্যাদি।
মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ,পাপ- পুণ্য ইত্যাদি বিপরীত দুটি ধারা সমানভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ هَدَیۡنٰهُ النَّجۡدَیۡنِ তরজমা: আমি তাকে দু‘টি পথপ্রদর্শন করেছি। [সূরা বালাদ-১০]
পরস্পর বিপরীত এই দুটি ধারা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে বিবেক বুদ্ধি দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। যে ব্যক্তি নিজের বিবেক বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহ এবং রাসূলের নির্দেশিত পথে জীবন অতিবাহিত করে তিনি সফলতার শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ে পৌঁছে যান। তার অন্তর ঈমানের আলোতে আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বাণীকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করে, অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন। এই ধরনের মুমিন বান্দাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে কোন নি’মাত দান করলে তারা অতি আনন্দে আত্মহারা হয় না, আবার দুঃখ কষ্টে, বিপদাপদে হতাশ হয় না। এধরনের মুমিনের সকল চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছা-আখাঙ্কা, কাজ-কর্ম, উঠা-বসা, চলাফেরা, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হয়ে থাকে । কিয়ামতের দিন এধরনের কলবের অধিকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর কাছে মুক্তি পাবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَوْمَ لاَ يَنْفَعُ مَالٌ وَلاَ بَنُوْنَ- إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ-
তরজমা: ক্বিয়ামতের দিন কোন অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি কারো কোন উপকারে আসবে না। একমাত্র সে ব্যক্তি মুক্তি পাবে, যে সুস্থ ক্বলব নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে।’ [সূরা শু‘আরা- ৮৮-৮৯]
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান-
লেখক: সিনিযয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।