|
প্রিন্টের সময়কালঃ ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৪৭ অপরাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:০০ অপরাহ্ণ

গার্মেন্টস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়: সবখানেই চাই ডে কেয়ার সেন্টার


গার্মেন্টস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়: সবখানেই চাই ডে কেয়ার সেন্টার


আলমগীর হোসেন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়:-

 

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। একসময় নারী কর্মী কেবল সীমিত কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও আজ তারা গার্মেন্টস শিল্প থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি দপ্তর থেকে বেসরকারি খাতসহ সর্বত্রই নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। এ অগ্রগতি নিঃসন্দেহে জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক শক্তি। তবে এ অগ্রযাত্রায় একটি বড় প্রতিবন্ধকতা এখনও দূর হয়নি কর্মজীবী মায়েদের জন্য শিশু যত্নের উপযুক্ত সুবিধা বা ডে কেয়ার সেন্টারের অভাব।
 

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (ধারা ৯৪) এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ৪০ বা তার বেশি নারী কর্মী থাকলে ছয় বছরের নিচের শিশুদের জন্য একটি শিশু যত্নকক্ষ থাকতে হবে। অর্থাৎ আইনগতভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই ডে কেয়ার সেন্টার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ আইন মানা হয় খুবই সীমিত আকারে। গার্মেন্টস খাত থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সর্বত্রই এ সেবার ঘাটতি প্রকট।
 

গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই শিল্পে কাজ করেন, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। শ্রম আইন অনুসারে প্রতিটি বড় কারখানায় ডে কেয়ার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ছবিটা ভিন্ন। আন্তর্জাতিক অর্থ করপোরেশনের (IFC) জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য শিশু যত্নসেবা দেয় এবং ৬১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিকল্পনাই নেই। ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে ডে কেয়ার আছে, সেখানেও কার্যকরভাবে সেবা নিতে পারছেন মাত্র ১৩ শতাংশ নারী শ্রমিক। এ অবস্থায় অনেক মা সন্তানকে ঘরে ফেলে কিংবা প্রতিবেশীর জিম্মায় রেখে কাজে আসেন। আবার অনেকেই সন্তান লালন-পালনের কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এতে যেমন পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি প্রতিষ্ঠানও অভিজ্ঞ শ্রমিক হারায়। অথচ যে কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানায় আধুনিক ডে কেয়ার চালু হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে শ্রমিকরা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকছেন, উৎপাদনশীলতা বাড়ছে এবং শ্রমিকদের সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 

শিক্ষাঙ্গনে পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে শিশু যত্নসুবিধা না থাকায় অনেক শিক্ষক গবেষণা, পাঠদান বা বিদেশি প্রশিক্ষণ সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ডে কেয়ার সেন্টার থাকলেও তা শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের চাহিদা পূরণে অপ্রতুল। তবে ইতিবাচক কিছু উদাহরণও আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে AIUB, Daffodil International University এবং BRAC University নিজস্ব ডে কেয়ার সেন্টার চালু করেছে। BRAC University ২০২৪ সালে “Ador” নামে একটি আধুনিক সেন্টার উদ্বোধন করেছে। Daffodil “Daffodil Angel’s Daycare” পরিচালনা করছে এবং AIUB শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য শিশু যত্নসুবিধা চালু করেছে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে সঠিক উদ্যোগ নিলে শিক্ষাঙ্গনে ডে কেয়ার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং কার্যকর।
 

ডে কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র নারী কর্মীর ব্যক্তিগত সুবিধার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি শিশুদের সুরক্ষা ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য। একটি মানসম্মত ডে কেয়ার শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ, পরিচর্যা, খেলাধুলা, পুষ্টি ও প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করে। অন্যদিকে কর্মজীবী মায়েরা সন্তানকে নিরাপদ হাতে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন, ফলে কর্মক্ষেত্রে তাদের মনোযোগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতাও বাড়ে। গবেষণা বলছে, যেখানে ডে কেয়ার সুবিধা থাকে সেখানে কর্মীর অনুপস্থিতি কমে এবং চাকরি ছাড়ার হারও হ্রাস পায়।
 

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ভারতে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনের বেশি নারী কর্মী থাকলে ডে কেয়ার বাধ্যতামূলক। নেপালেও অনুরূপ আইন রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অনুদান দিয়ে ডে কেয়ার পরিচালনা করে, যাতে মা-বাবারা নিশ্চিন্তে কর্মজীবনে মনোযোগী হতে পারেন। বাংলাদেশেও যদি বিদ্যমান আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ আরও টেকসই হবে।
 

নারী ক্ষমতায়ন কেবল সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; এর জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সহায়তা। ডে কেয়ার সেন্টার সেই সহায়তার অন্যতম। গার্মেন্টস শিল্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস থেকে হাসপাতা,  সর্বত্রই এ সুবিধা থাকা অপরিহার্য। আইন আছে, কিছু ভালো উদাহরণও আছে; এখন দরকার কার্যকর বাস্তবায়ন ও দৃঢ় নজরদারি। কারণ, ডে কেয়ার মানে শুধু নারীর স্বস্তি নয়; এটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা, শিশুর নিরাপত্তা এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ভিত্তি। তাই এখন সময় এসেছে দৃঢ়ভাবে বলার, "গার্মেন্টস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সবখানেই চাই ডে কেয়ার সেন্টার।"


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫