পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি যার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যায় জাহাজ

প্রকাশকালঃ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:২৬ অপরাহ্ণ ১৭৯ বার পঠিত
পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি যার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যায় জাহাজ

ব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন উনবিংশ পর্ব

জাহাজের সুসজ্জিত ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কারণ, সেখানে নানা দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষেরা প্রাণ খুলে কথা বলেন। তাঁদের আজকের আলাপের বিষয়—শেষ অপারেশন। আজই অ্যান্টার্কটিকা অভিযান শেষ হতে যাচ্ছে। চার ঘণ্টার অপারেশনে যাব ডিসেপশন আইল্যান্ডে। কাল জাহাজ ফিরতে শুরু করবে উসুয়াইয়া বন্দরের দিকে।

জোডিয়াক নিয়ে চলল এক বৃত্তাকার উপসাগরের পাড়ে। দ্বীপে নেমে দেখি, চারদিকে পাহাড়ঘেরা। মনে হচ্ছে, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। চারদিকে ছাই রং, বরফ-সাদার আধিক্য কম। কী নাম এই দ্বীপের? গাইডকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘এটাই ডিসেপশন আইল্যান্ড।’ দ্বীপটি ঘোড়ার নালের আকৃতির। 


ডিসেপশন আইল্যান্ড দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। এটি নিরাপদ প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়। গাইড জানালেন, এখানে বিভিন্ন সময় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আবদ্ধ বৃত্তাকার উপসাগর তৈরি হয়েছে। আমাদের জাহাজ সেখানে দাঁড়িয়ে। আমরা তীরে। এখানে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির ঝুঁকি এখনো আছে। কেউ কেউ এটিকে দক্ষিণ তীরের অগ্নিশিখা বলেছেন। এবার পরিষ্কার বোঝা গেল, কেন চারপাশে পোড়া চেহারা। এদিকটায় বেশ সমতল উপকূল। সে উপকূল কাঁকরযুক্ত কালো বালুকাময়। কালো বালুর মধ্য দিয়ে সবাই হাতের বাঁয়ে পথ ধরে হাঁটছেন। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। সামান্য এগোতেই দেখি, পথ ভেজা ও কর্দমাক্ত। বুট জুতা তলিয়ে যাচ্ছে কাদার মধ্যে। 

দূরে কিছু ভাঙা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সবাই সেদিকেই যাচ্ছি আমরা। সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপে বেরিয়ে এল, এই ভাঙা বাড়িগুলো একটি ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক স্টেশন। নাম বিসকো হাউস। রয়্যাল নেভির মাস্টার জন বিসকোর নামে নাম হয়েছে ‘বিসকো হাউস’। আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতে বাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি কক্ষ একেবারে মাটিতে দেবে গেছে। বেশ কয়েকবার আগ্নেয়গিরি খেপে উঠেছে এখানে, তবে বেশি ক্ষতি করেছে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালের অগ্ন্যুৎপাত। ব্রিটিশ ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঠিকে থাকলেও রাশিয়া আর চিলির বৈজ্ঞানিক স্টেশন একেবারে ছাই হয়ে গেছে।


একেকজন করে আমরা উঁকি দিচ্ছি ঘরের ভেতরে। দেখলাম, কিছু আসবাব কোনোমতে টিকে আছে, তবে বরফে ঢেকে আছে বলে সেগুলোর আকার ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। এই দ্বীপ অস্থায়ী তিমি শিকারের স্টেশন ছিল। এই বাড়িগুলো স্টেশনের ডরমিটরি। এখন পরিত্যক্ত। পর্যটকদের জন্য অ্যান্টার্কটিকার সেরা আকর্ষণগুলোর একটি এটি।

সদলবলে আবার পেছনের দিকে ফিরে আসছি। একেবারেই সমতল উপকূলের মাঝখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে মরিচা ধরা বয়লার ও ট্যাংক। কতকগুলো দাঁড়িয়েই আছে, কিছু পরিত্যক্ত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ। আচমকা দেখলে মনে হবে, কোনো ধ্বংস হয়ে যাওয়া শিল্পকারখানা। এই দ্বীপে তিমি ও সিল নিধন হতো, তিমির তেল আহরণ করা হতো, সেই তেল রাখা হতো এমন বৃহৎ আকারের ট্যাংকে। মনে হচ্ছে, একটি উন্মুক্ত জাদুঘর পরিদর্শন করছি।

ডিসেপশন শব্দের বাংলা অর্থ প্রতারণা। ডিসেপশন আইল্যান্ডের প্রকৃতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জায়গাটা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতারণার শিকার। মরিচা ধরা বৃহৎ কনটেইনারগুলো ধারণা দিচ্ছে, কেন বড় সিল ও তিমি শিকারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ডিসেপশন আইল্যান্ড।


এই দ্বীপে প্রথমে থাবা পড়ে ব্রিটিশদের। এরপর আমেরিকান সিল শিকারি নাথানিয়েল পামার ( জন্ম ১৭৯৯- মৃত্যু ১৮৭৭) আসেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি দুই দিন ছিলেন এখানে। পামার দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘ডিসেপশন আইল্যান্ড’। এটিকে তাঁর সাধারণ কোনো দ্বীপের মতো মনে হয়নি। বৃত্তাকার, সঙ্গে আবার প্রবেশদ্বার, বেলাভূমি সমতল, কিছুটা রিংয়ের মতো। পামারের কাছে এই দ্বীপকে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল এর আকৃতি দেখে। তাই হয়তো এর নাম রাখেন তিনি ‘প্রতারণা দ্বীপ’।

১৮১৯-২০ সালে মুষ্টিমেয় কিছু জাহাজ দিয়ে শিল্পের সূচনা হলেও পরের দুই বছরের মধ্যে এখানে জাহাজ ভেড়ে প্রায় এক শ। জাহাজেই ছিল কারখানা। সেই কারখানায় শুধু তিমি থেকে ব্লাবার বের করা যেত, মৃতদেহ ব্যবহার করা যেত না। ব্লাবার হলো একধরনের তিমির তেল বা চর্বির মতো জিনিস। উচ্চ মুনাফা ছিল সে ব্যবসায়। শুধু ব্রিটিশরা নয়, এই ভূরাজনীতির অংশী নরওয়েজীয়রাও। খেয়াল করে দেখলাম, নরওয়েজীয়দের তিমি শিকার স্টেশনের বড় ডাইজেস্টার এখনো সৈকতে পড়ে আছে। তিমি থেকে ব্লাবার আহরণে ব্যবহৃত মরিচা ধরা ডাইজেস্টারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটি তৈরি হয়েছিল তিমি নিধনের মৃত্যুপুরী হিসেবে।


২০ শতকের গোড়ার দিকে ডিসেপশন আইল্যান্ডে ব্রিটিশরা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়। দ্রুত অধিক মুনাফার আশায় তারা শুরু করে তিমি থেকে তেল আহরণ। তিমি শিকার কার্যক্রম বৃহৎ হয়। কারণ, এখানে আছে একটি সমতল উপকূল, আছে বিশুদ্ধ পানি। খবর চাউর হয়ে গেল চারদিকে। ভারতবর্ষ অবশ্য তখন সতীদাহ প্রথার মতো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত! নরওয়েজীয়-চিলীয়রা খবর পেয়ে গেল। ছুটে এল তিমির তেল নিতে। ব্রিটিশরা ভাবল, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। তৈরি করল কিছু বিধিনিষেধ। অ্যান্টার্কটিকার বাইরে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আগেই দখলে রেখেছিলে ব্রিটিশরা। সেখানে তাদের যথেষ্ট সৈন্যসামন্তের উপস্থিতি ছিল। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ডিসেপশন দ্বীপটিকে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অংশ হিসেবে ঘোষণা করল। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে ডিসেপশন দ্বীপের দূরত্ব ১ হাজার ২৪০ কিলোমিটার। এরপর দ্বীপ হয়ে যায় একচ্ছত্র ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন। ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত ডাক পরিষেবা প্রতিষ্ঠা করে। দ্বীপের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও কাস্টমস অফিসার নিয়োগ করে। ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিমি শিকার কোম্পানিগুলো ফকল্যান্ড সরকারকে উপযুক্ত লাইসেন্স ফি প্রদান করে তবেই কাজ করতে পারবে।

অ্যান্টার্কটিকার নিকটতম প্রতিবেশী আর্জেন্টিনা ঘটাল অন্য ঘটনা। ১৯৪২ সালে ডিসেপশন আইল্যান্ডকে নিজেদের ভূখণ্ড ঘোষণা করে সীমানা এঁকে পতাকা উড়িয়ে রেখে যায় তাঁরা। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরেকটি ব্রিটিশ অপারেশন ঘটে এখানে। ব্রিটিশরা আবার ডিসেপশন দ্বীপে একটি স্বল্পস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুদের জাহাজ যাতে নিরাপদে নোঙর করতে না পারে, তাই সেই আয়োজন।

যুগে যুগে অনেক দেশ ডিসেপশন আইল্যান্ডের মালিকানা দাবি করেছে; কিন্তু এখনো এটি আছে অ্যান্টার্কটিক চুক্তিব্যবস্থার অধীন। ভাগ্যিস চুক্তিব্যবস্থা হয়েছিল, তা না হলে আমাদের পূর্বাচলের মতো জমি কেনাবেচা শুরু হয়ে যেত এখানে!