নবজাগরণ পৃথিবীতে তাওহিদ ও ঈমানের

প্রকাশকালঃ ১৪ জুন ২০২৩ ০৩:১৯ অপরাহ্ণ ১৬৯ বার পঠিত
নবজাগরণ পৃথিবীতে তাওহিদ ও ঈমানের

বরাহিম (আ.) শহরের এক সম্ভ্রান্ত মূর্তিপূজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বড় বড় মূর্তি তৈরি করে তারা কেনাবেচা করতেন। অতএব, ইবরাহিম (আ.)-এর পরিবারের সঙ্গে মূর্তির সম্পর্ক শুধু বাণিজ্যিক ছিল না; বরং আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। এসব মূর্তির সঙ্গে আর্থিক সুফল লাভের পাশাপাশি ধর্মীয় আবেগ জড়িত ছিল।

ফলে এমন অন্ধকার পরিবেশে ঈমানের আলো জ্বলে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর ভেতরের সুস্থ অন্তরকে নবুয়তের জন্য প্রস্তুত করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় নতুন পৃথিবীর জাগরণ। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এর আগে ইবরাহিম (আ.)-কে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছি এবং আমি তার সম্পর্কে অবগত ছিলাম।

যখন তিনি তার পিতা ও সম্প্রদায়কে জিজ্ঞাসা বললেন, এই মূর্তিগুলো কী, তোমরা যাদের পূজা করছ? তারা বলল, আমরা তো পূর্বপুরুষদের এসবের পূজা করতে দেখেছি।’ (সুরা : আনবিয়া, আয়াত : ৫১-৫৩)


তিনি এমন পর্যায়ে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন, যেখানে বড় বিদ্রোহগুলোও পৌঁছতে পারেনি। তিনি সেই স্থান থেকে জাগরণ শুরু করেন, যেখানে মানুষ জন্মগ্রহণ করে ও জীবন যাপন করে। তিনি নিজ ঘরের ভেতর সব কুসংস্কার নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেন।

পবিত্র কোরআনে অত্যন্ত যৌক্তিক ভাষায় ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনার বিবরণ এসেছে। ইবরাহিম (আ.)-এর মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে তাঁর প্রতি মূর্তিপূজকদের ক্রোধ ও সমালোচনা, আগুন প্রজ্বালন করে তাকে নিক্ষেপ এবং অহংকারী শাসকের সামনে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত তর্কবিতর্কের আলোচনা কোরআনে এসেছে।

অবশেষে বিদ্রোহের পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হলো। ইবরাহিম (আ.)-এর বিরুদ্ধে পুরো সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরিবার তাঁকে পরিত্যাগ করে।


অতঃপর রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে তিনি দেশত্যাগ করেন। কিন্তু এত কিছু ঘটলেও তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন ছিল না। মনে হয় যেন তিনি এ সব কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রশান্ত মনে দেশ ছেড়ে যান। তাঁর সঙ্গে ছিল শুধু পুরো জীবনের মূলধন-ঈমান। এরপর নানা দেশে ঘুরতে থাকেন। সব জায়গার অবস্থা ছিল অভিন্ন। সবখানে মূর্তিপূজার জয়জয়কার। মিসরে এসে তিনি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন। সেখানে তাঁর স্ত্রীর প্রতি রাজা অসৎ উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালে তাঁর হাত নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর শামে এসে তিনি কিছুটা স্থির হন। সেখানে তিনি অগ্নিপূজা প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান জানান। এখানকার উর্বর ভূমি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, খাদ্য ও পানির সমাহার থাকার দরুন এখানে বসবাস করা সহজ ছিল। কিন্তু এখানেও তিনি বেশিদিন স্থির থাকেননি। আসলে ইবরাহিম (আ.)-এর নিজস্ব বলতে কিছুই ছিল না। কোনো স্থান বা দেশের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি পুরো বিশ্বকে নিজ দেশ এবং পুরো মানবগোষ্ঠীকে নিজ পরিবার বলে মনে করতেন। অতঃপর ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও দুগ্ধজাত সন্তান নিয়ে অন্যত্র যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অতঃপর তিনি সস্ত্রীক শক্ত পাহাড়ে ঘেরা এক সংকীর্ণ উপত্যকায় এসে পৌঁছেন। সেখানকার শুষ্ক আবহাওয়া, পানিশূন্য নির্জন প্রান্তরে অবলা স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে একাকী রেখে আসতে বলা হয়। মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন ও তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থায় ভরপুর ছিল ইবরাহিমের অন্তর। আল্লাহর সিদ্ধান্তে নিজেকে সঁপে দেন তিনি। তাই তাঁর অন্তরে ছিল না অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা বা বিরক্তিভাব। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর সিদ্ধান্ত পালন করেন তিনি। 


এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বাহ্যিক যুক্তি-তর্ক, অস্বাভাবিক নির্দেশনা বা উপকরণ না থাকার কোনো বিষয়ই তাঁর মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলেনি।

অতঃপর বাহ্যিক সংকটের মুখোমুখি হয় ইবরাহিম (আ.)-এর পরিবার। তাঁর শিশুসন্তান প্রচণ্ড পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে। পানিশূন্য স্থানে সামান্য পরিমাণ পানির আশাও নিষ্ফল। তখন ইবরাহিম (আ.)-এর স্ত্রী হাজেরার হৃদয়ে জেগে ওঠে মায়ের আকুতি। ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। বের হয়ে পানির সন্ধান করতে থাকেন। 

কোনো কাফেলা দেখা যায় কি না তারও খোঁজ নেন তিনি। কখনো অস্থির হয়ে তিনি দুই পাহাড়ের মধ্যভাগে দৌড়ে যান। কখনো অস্থির মনে ফিরে এসে দেখেন, সন্তান জীবিত আছে কি না! এরপর আবার পানির খোঁজে বের হন। পানি বা কোনো মানুষের চিহ্ন পাওয়া যায় কি না সে আশায় দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। বাহ্যিক পরিস্থিতিতে কখনো অস্থির হয়ে পড়ছিলেন। আবার ঈমান ও আল্লাহর আস্থায় কখনো তাঁর মন প্রশান্ত হচ্ছিল। তিনি জানতেন, উপায়-উপকরণের সন্ধান করা আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। তাই হতাশ হওয়া বা নিষ্কর্ম হয়ে থাকা অনুচিত। বিশাল পৃথিবী কখনো এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়নি। তখন ঐশী রহমতের জোয়ার ওঠে। অলৌকিকভাবে পানির প্রবাহ শুরু হয়। পানির সেই প্রবাহ যে শুরু হয়েছে আর বন্ধ হয়নি। পুরো সৃষ্টিজগতের তৃষ্ণা নিবারণ করেছে সেই সুপেয় পানি। সব যুগে সব জাতির জন্য সেই পানি ছিল খাদ্যতুল্য ও আয লাভের উপায়।


একজন মুমিন নারীর সেই অস্থিরতার চিত্র আল্লাহর পছন্দ হয়। এই কাজকে তিনি শাশ্বত রূপ দেন। পৃথিবীর বড় বড় সব জ্ঞানী, দার্শনিক, পণ্ডিত, রাজা ও বাদশাহকে তা পালন করতে হয়। দুই পাহাড়ের মধ্যখানে সায়ি বা দৌড়ানো ছাড়া কারো হজের কার্যক্রম পূর্ণ হয় না; বরং একজন মুসলিমের অবস্থান এই সায়ির মাধ্যমে সত্যিকারভাবে ফুটে ওঠে। এতে বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয় ঘটেছে। এতে যেমন বিশ্বাসের ছাপ রয়েছে তেমনি বুদ্ধি-বিবেকের প্রভাবও রয়েছে। জীবনের কল্যাণে তিনি নিজ বুদ্ধিকে ব্যবহার করেছেন। অনেক সময় বুদ্ধির কাছে আবেগের কোনো স্থান থাকে না। তবে আবেগ ও অনুভূতির প্রভাব বুদ্ধি ও বিবেকের চেয়ে অনেক বেশি। সাফা ও মারওয়ার মধ্যভাগে দৌড়ানোর মূল লক্ষ্য আল্লাহর আনুগত্য ও পূর্বসূরিদের অনুসরণ। এই দৌড়ের মূল রহস্য হলো আল্লাহর ভালোবাসা ও আনুগত্য। 

নিজ পরিবারের জন্য ইবরাহিম (আ.) দোয়া করে বলেন, ‘হে আমাদের রব, আপনার ঘরের কাছে অনুর্বর উপত্যকায় আমার বংশধরদের কতেককে বসবাস করিয়েছি; হে আমাদের রব, যেন তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, অতএব কিছু মানুষের অন্তর তাদের প্রতি আগ্রহী করুন এবং বিভিন্ন ফল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করুন, যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৭)

আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘...আমি কি তাদের এক নিরাপদ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে  আমার পক্ষ থেকে রিজিক হিসেবে সব ধরনের ফল-ফলাদি আমদানি হয়? তবে তাদের অধিকাংশই তা জানে না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৭)