|
প্রিন্টের সময়কালঃ ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৪২ অপরাহ্ণ     |     প্রকাশকালঃ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:০৫ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের ঋণমানে সক্ষমতার বার্তা পাচ্ছে না বিশ্ব


বাংলাদেশের ঋণমানে সক্ষমতার বার্তা পাচ্ছে না বিশ্ব


বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সির কাছ থেকে অনেকটা একই রকম বার্তা আসার কারণে বাইরে থেকে বাংলাদেশকে দেখা হবে ভিন্ন চোখে।

শেষ পর্যন্ত ফিচ রেটিংসও বিশ্বের অন্য দুই বড় ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানের সুরেই কথা বলেছে। তারাও আর বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না, তাই পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ করে দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, একের পর এক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা বা রেটিং এজেন্সি যখন কোন দেশের ব্যাপারে একই সুরে কথা বলে, তখন বাইরের বিশ্বের কাছে একটিই বার্তা যায়। সেটি হলো, দেশটির অর্থনীতি সক্ষমতা হারাচ্ছে।

বিশ্বে ঋণমান যাচাইয়ের কাজটি যারা করে, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য তিনটি প্রতিষ্ঠান—মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস বা এসঅ্যান্ডপি এবং ফিচ। এই তিন প্রতিষ্ঠান পরিচিত ‘বিগ থ্রি’ হিসাবে। গত মে মাসে প্রথম খারাপ খবরটি আসে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিসের কাছে থেকে। দুই মাস পরেই এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এবং আরও দুই মাস পরে, গত সোমবার ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের পূর্বাভাস ও ঋণমান সম্পর্কে হতাশাজনক খবরই দিল।


বাংলাদেশের অর্থনীতি যে চাপের মধ্যে রয়েছে, তা আর্থিক খাতের কর্তারাও এখন আর অস্বীকার করেন না। তবে মাত্র চার মাসের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি ঋণমান যাচাইকারী সংস্থার কাছ থেকে অনেকটা একই রকম বার্তা আসার কারণে বাইরে থেকে বাংলাদেশকে দেখা হবে ভিন্ন চোখে। অর্থনীতির বিশ্লেষক ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যেমনটা বলছেন, ‘বাইরে থেকে বাংলাদেশকে আর খুব ভালো দেখাচ্ছে না।’

গত ৩০ মে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এই পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি বলেছিল, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।

এরপর গত ২৬ জুলাই এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের আউটলুক বা দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল থেকে নেগেটিভ বা নেতিবাচক করে দেয়। এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ দেখায় এসঅ্যান্ডপি। প্রথমত, বিদেশি মুদ্রায় স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ পরিশোধের যে বাধ্যবাধকতা আছে, তার অবস্থা আগামী বছর আরও খারাপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে।


ডলার-সংকটের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও মন্তব্য করেছিল এসঅ্যান্ডপি। তাদের মতে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম, ফলে সরকারের ওপর নজরদারি সীমিত। ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে; কিন্তু বিএনপি অংশ নেবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।

সর্বশেষ দুঃসংবাদটি এসেছে ফিচ রেটিংসের পক্ষ থেকে। পূর্বাভাস নেতিবাচক বা ঋণাত্মক করেছে তারা। তবে রেটিংস কমায়নি, কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ এখনো সক্ষম। পূর্বাভাস নেতিবাচক করার কারণ হিসেবে ফিচ বলেছে, দেশটির বহিস্থ খাতের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিদেশ থেকে ঋণ পেলেও রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকাতে তা যথেষ্ট হচ্ছে না। দেশে যে ডলারের সংকট চলছে এবং তা থেকে উত্তরণের যে আশু কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, তা-ও উল্লেখ করেছে ফিচ।


ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতির রেটিং বা মান স্থিতিশীল থেকে ঋণাত্মক হলে সবার আগে আস্থার ওপর আঘাত আসে। বিদেশি কেউ যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তিনি সবার আগে দেখবেন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য রেটিং এজেন্সিগুলো এই দেশ সম্পর্কে কী বলছে।


জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাগুলো যখন একই সুরে বলে বাইরে থেকে ধাক্কা নিবারণের সক্ষমতা বাংলাদেশের কমে যাচ্ছে, তাহলে একটাই বার্তা সবার কাছে যাবে। আর এই বার্তাটি হলো, কোনো চাপ এলে দেশটি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা হারাচ্ছে। দেশটি সুরক্ষিত নয়।’

তাঁর কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরির বক্তব্যেও। তিনি বলেন, তিনটি বড় ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা একই সুরে কথা বলার অর্থ হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত নরম হচ্ছে এমন একটি বার্তা আন্তর্জাতিকভাবে যাচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাত, যারা ঋণ দেয় কিংবা বিনিয়োগ করে, তাদের কাছে ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, ‘আমরা যেসব ঋণপত্র খুলি, সেগুলো বিদেশি ব্যাংকের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি তারা বিবেচনা করে ঋণমানের আলোকে। ঋণমান খারাপ হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক ঝুঁকি প্রিমিয়াম বাড়িয়ে অতিরিক্ত অর্থ চাইতে পারে। অর্থাৎ ব্যবসা করার খরচ বাড়বে। মূলকথা হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে তারা দ্বিধা বোধ করবে।’

বাংলাদেশ সম্পর্কে ফিচ রেটিংস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি চাপের মধ্যে থাকবে মূলত দুটি কারণে—আমদানির ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও বিনিময় হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ। প্রতিষ্ঠানটির মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষে রিজার্ভ দাঁড়াবে ২১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের বৈদেশিক দায় মেটানো যাবে।

ফিচ অবশ্য মনে করে, রিজার্ভ কমে গেলেও ২০২৪-২৫ সময়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সমস্যায় পড়বে না। এর কারণ হলো, সমপর্যায়ের দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধে কম অর্থ ব্যয় করতে হবে, যেহেতু ঋণের ৫৯ শতাংশই বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে নেওয়া। একই সঙ্গে, আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের বহিস্থ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে।


অর্থনীতি বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন অবশ্য মনে করছেন, ফিচ বাংলাদেশের ঋণমান স্থির রাখলেও তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, তার ফলে ‘রেড ফ্ল্যাগস’ (সতর্কসংকেত) উঠে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এখন উচিত হবে, অর্থনীতির পূর্বাভাস ও ঋণমান আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে কাজ করা।

তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উল্টো পথে হাঁটছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে ডলারের ভবিষ্যৎ দাম ঠিক করে দিয়েছে, তা বার্তা দিচ্ছে যে তারা ডলারের বর্তমান দামের মতো এর ভবিষ্যৎ দামও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তিনি বলেন, ‘এর মানে হচ্ছে, নীতিগতভাবে আপনি নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, আর্থিক খাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, বাস্তবায়নের চিত্র বলছে যে সেগুলো কাজ করছে না। তাঁর পরামর্শ, সমস্যা কোথায় হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হোক।


সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির     |     প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ   +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ   +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫