অমর একুশে বই মেলার ইতিহাস

প্রকাশকালঃ ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০১:৪৭ অপরাহ্ণ ২২৫ বার পঠিত
অমর একুশে বই মেলার ইতিহাস

কোটি বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বই মেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের একটি মহা মিলনমেলা হিসেবে পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। স্বাধীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন, যার শুরুটা হয়েছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামকরণ এর মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মহান ভাষা শহীদদের ত্যাগের স্মৃতিকে অক্ষত রাখতেই তৎকালীন অমর একুশে গ্রন্থমেলার যাত্রা শুরু করা হয়, যা আজও অমর একুশে বই মেলা হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গন সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।


বইমেলা্র শুরুটা হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে, ১৯৭২ সালে। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা একটা চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বসে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায়। এ ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। সে বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করেছিল। তবে চিত্তরঞ্জন সাহার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (পরে মুক্তধারা প্রকাশনী) ছিল একমাত্র বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামসহ আরো কিছু প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসেন। এভাবেই চলতে থাকে আগামী কয়েক বছর।

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও তাদের দেখাদেখি আরো অনেকে বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্ত বাবু একাই এ আয়োজন করতেন। তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হন। এরমধ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির সে সময়ের মহাপরিচালক 'আশরাফ সিদ্দিকী' বাংলা একাডেমিকে বই মেলার আয়োজনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। এদিকে ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি, এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

তখনকার সময়ে ৭ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু ১৯৮১ সালে বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। এরপর প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ আবার ২১ দিনে বৃদ্ধি করা হয়। তারপর ৯৮৩ সালে 'কাজি মন্জুরে মওলা' বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' আয়োজন সম্পন্ন করেন এবং ১৯৮৪ সালে এসে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয়, সেই থেকে এই গ্রন্থমেলার নাম হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য মহান ভাষা শহীদদের আত্মোৎসর্গের অম্লান স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতেই এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ এবং তা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসেই পালিত হয় যা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তবে ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়।

মেলা চলাকালীন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এছাড়া মেলাতে লেখককুঞ্জ রয়েছে, যেখানে লেখকেরা উপস্থিত থাকেন এবং তাঁদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সাথে মতবিনিময় করেন। মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন মোড়ক উন্মোচিত বইগুলোর নাম, লেখক ও প্রকাশকের নাম ঘোষণা করা হয় এবং দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়।


২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলায় চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয়। পূর্ববর্তী বছরে প্রকাশিত বইয়ের গুণমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারটি আনুষ্ঠানিক নাম চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার। এছাড়া স্টল ও অঙ্গসজ্জার জন্য দেওয়া হয় সরদার জয়েনউদদীন স্মৃতি পুরস্কার। সর্বাধিক গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য সেরা ক্রেতাকে দেওয়া হয় পলান সরকার পুরস্কার।