বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন: বহুমাত্রিক সংগ্রাম
প্রকাশকালঃ
১৪ মার্চ ২০২৪ ১২:০৫ অপরাহ্ণ ৩১৫ বার পঠিত
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা পুরুষের চেয়ে কতটা এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন থাকলেও মূলধারায় এসে একজন আদিবাসী নারী কতটা অধিকার পায়, তা নিয়ে কোনো গবেষণা, প্রতিবেদন হয় না। সত্তরোর্ধ্ব এই ম্রো নারী বনপাহাড়ে কত শ্বাপদ-সংকুল জীবন ফেলে এসেছেন তা বর্ণনাতীত। এখন শেষ জীবনে ছোট্ট ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন ছোট হয়ে আসা তার পৃথিবীটাকে। রেংয় ম্রো পাড়া, দোছড়ি ইউনিয়ন, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান। আমরা আজকাল নারীর ক্ষমতায়ন শব্দবন্ধটি খুব শুনতে পাই।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়নসংস্থা, গণমাধ্যম, সমাজমাধ্যম সর্বত্রই আজকাল এই শব্দবন্ধটি হরহামেশা ব্যবহার হয়। সব মাধ্যমেই নারীর সমস্ত প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প উঠে আসে। এতে অনেকে অস্বস্তি বোধ করলেও বলা চলে সমাজে নারীদের এই ক্ষমতায়নকে সাধুবাদও জানাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দবন্ধটি নারীর গণ্ডিকে সীমিত করে দিচ্ছে না তো? এই প্রশ্নটিতে হয়তো মনে হতে পারে আমি নারীর ক্ষমতায়ন চাই না। ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং আমি চাই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হোক।
আপাতদৃষ্টিতে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্পের মধ্যে যে আরও নানান সূক্ষ্ম বিষয়, বঞ্চনা, সংগ্রাম, যাতনা, শোষণ, শ্রেণিপ্রশ্ন রয়েছে, সেসব আলাপের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজে সমতার সম্পর্ক তৈরি হোক, এমনটাই তো চাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন দিয়েই আমরা এগোতে পারি। যেমন, কোন নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে? বাংলাদেশের সকল নারী একইরকম পরিচয় ধারণ করেন না। এখানে মূলধারার নারীরা তো রয়েছেই, আদিবাসী আছে, শ্রমিক আছে, আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, উচ্চশিক্ষিত— এরকম নানান পরিচয় ও অবস্থানের মানুষ। অর্থাৎ বলা চলে নারীর পরিচয় কেবল নারী নয়; তার দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র কাঠামোতে এই পরিচয় নানান রকমের হয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী তার সংগ্রাম চলমান থাকে।
এরকম বাস্তবতায় সকল নারীর এগিয়ে আসার ম্যারাথন দৌড়ের রাস্তার মাপ সমান নয়। তাই সত্যিকারের ক্ষমতায়ন ঘটাতে চাইলে এসকল বর্গগুলোকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে সেই অনুযায়ী আইন, নীতি, কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে কাজ করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আইন, নীতি, রাষ্ট্রীয় সংবিধান এসব কঠিন কঠিন প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়-আশয় সমাজের অভ্যন্তরে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক সেখানে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?
এই প্রশ্নটা আমাকে প্রায়শ ভাবায় নিজের অভিজ্ঞতা উপলব্ধি থেকে। আমার জন্ম, জীবন আমাকে অনেকগুলো পরিচয় দিয়েছে। আমি আদিবাসী। চাকমা জাতির একজন মানুষ। আমার জেন্ডার নারী। ধর্মীয় পরিচয়ে বৌদ্ধ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘু। রাষ্ট্র অবশ্য আমাকে আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে পরিচিত করাতে চায়। আমার এমন অনেকগুলো পরিচয়, আমাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন বাঙালি মুসলমান নারীর জীবন সংগ্রাম থেকে আলাদা করেছে। এর মানে এই নয় আমাদের উভয়ের জীবন সংগ্রাম একেবারেই আলাদা, কিছুক্ষেত্রে মিল যেমন রয়েছে, রয়েছে ভিন্নতাও। যেমন, একজন মুসলিম বাঙালি নারীকে লড়াই করতে হয় মূলধারার বৃহত্তর সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে।
পক্ষান্তরে আদিবাসী নারীর লড়াই বহুমাত্রিক যেখানে তাকে একদিকে যেমন নিজের সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বৃহত্তর সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আদিবাসী হওয়ার সুবাদে এই রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগ্রামটা কঠিনতর হয়। এত লড়াইয়ের মধ্যে ভেতরে ভেতরে যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে ক্রমশ, সেগুলোর মাশুল নারীর ওপরেই এসে পড়ে। আদিবাসী সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের বাঙালি মননের এক অংশে যেমন নেতিবাচক ধারণা আছে যে আদিবাসীরা অসভ্য, জংলী, গাছপালার পূজো করে, যা তা খায়, আবার অন্যদিকে এমনও বলা হয় যে আদিবাসী সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, এখানে নারীরাই পুরুষের ভূমিকা পালন করে থাকে এবং অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে বাঙালি সমাজের পুরুষের মতো।
অথচ, খেয়াল রাখা হয় না আদিবাসী সমাজের মধ্যে বৃহত্তর জাতির সান্নিধ্য কীভাবে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এমনকি পরিবর্তন ঘটাচ্ছে আদিবাসী সমাজের পুরুষদের মধ্যেও, যার ফলে আদিবাসী নারীর সংগ্রামের মধ্যেও যুক্ত হয়েছে নানান মাত্রা। আমাদের মনে রাখা উচিত, কোনো সমাজ কালের পর কাল একইরকম অনড়-অপরিবর্তনশীল থাকে না।
সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছুই ক্রমাগত রূপান্তরিত হতে থাকে। কোনো অঞ্চলে বহুজাতির পাশাপাশি অবস্থানের কারণে পারস্পরিক অনেক চিন্তা, চেতনা, চর্চার লেনদেন ঘটে। শান্তিপূর্ণ জবরদস্তিবিহীন অবস্থানের ক্ষেত্রে সহাবস্থান ঘটে, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু যখন সেখানে কোনো জাতির দ্বারা অপর জাতির ওপর একপাক্ষিক ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, শোষণ, দখলের ঘটনা ঘটে তখন সেখানে সহাবস্থান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং তৈরি হয় ক্রমাগত সংঘাত ও জুলুমের ক্ষেত্র। এই জুলুম কেবল জাতিতে জাতিতে থাকে না, এই জুলুমের রক্ত বয়ে চলে নিজের ভেতরেও। যেমনটা আদিবাসী সমাজে ঘটছে।
আদিবাসীদের জমি জোরপূর্বক দখল, তাদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, গণহত্যা চালানো অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের সীমানায় প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে আদিবাসী সমাজের ওপর যে নিপীড়ন চলে, তার প্রভাবে আদিবাসী সমাজেও তৈরি হয়েছে প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর জাতীয়তাবাদের মধ্যে থাকে পুরুষতান্ত্রিক একটি চেতনা, যেখানে পুরুষ জাতীয়বাদের রক্ষক ও জাতির নিরাপত্তাদানকারীর ভূমিকা নিয়ে থাকে। ওই রক্ষক ভূমিকা নিতে গিয়ে পুরুষ মূলত প্রভু হয়ে উঠতে চায়, যেখানে সে নারীর সীমানা চিহ্নিত করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তাহলে কি নারীর ঘর সীমাবদ্ধ হয়ে আসে না?
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম পাড়ার নারীরা জঙ্গলে যেতেন শাকসবজি তুলতে। বেশ দূরেই ওই জঙ্গলগুলো। দুই-তিন জন মিলে গিয়ে শাকসবজি তুলে আসার পথে পরিচিত ঘরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে করতে ফিরতেন। পরে ওই জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প হলো। সেখানে নারীরা আর যেতে পারেন না। আবার দেখতাম ছড়ায় গোছল করতে যেতেন আদিবাসী নারীরা। আদিবাসী সমাজে যেহেতু আব্রু নিয়ে তেমন কোনো ছুতমার্গীয় ব্যাপার-স্যাপার নেই, তাই নারীদের এই খোলা আকাশের নিচে বুক পর্যন্ত বসনে স্নানের দৃশ্য কখনোই কামনাক