মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দিতে হবে জোর বেশি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়
প্রকাশকালঃ
০৮ জুন ২০২৩ ০১:৫৫ অপরাহ্ণ ১৩৭ বার পঠিত
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ খরচে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এ সময় আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করা মানে আগুনে ঘি ঢালার মতো। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তাই বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা দরকার। সব মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকটে সাড়ে ৭ শতাংশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন নয়, বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই বেশি জোর দিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের যৌথ আয়োজনে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এম মান্নান। র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বাজেট বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কঠিন সময়ের মধ্যে বাজেটটি এসেছে। বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় আছে, বিশেষ করে করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ধাক্কাটা বেশি লেগেছে। বাংলাদেশও কঠিন সময় পার করছে। তার কারণ, নব্য ধনীর চাকচিক্য থাকলেও আমাদের অর্থনীতির গভীরতা কম।’
ব্যবসায়ীরা অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বাতিল চাইলেও প্রস্তাবিত বাজেটে সেই দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয়, উপায় ছিল না। তার চেয়ে খারাপ হচ্ছে, ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয় না। এগুলো বাতিল করা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অবাস্তব। সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়নও কঠিন।
এদিকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আবদুর রাজ্জাক বলেন, মানুষ এখন সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। প্রস্তাবিত বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সেটি সম্ভব নয়। উল্টো এই অর্জনের পেছনে ছুটলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। তাই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে বাস্তবসম্মত করা দরকার। একই সঙ্গে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) কাটছাঁট করা দরকার।
বর্তমান সংকট নিরসনে ব্যাংকঋণের সুদের হার ও ডলারের বিনিময় হার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, অর্থনীতি যখন সুদৃঢ় ছিল, তখন এসব সংস্কার করা দরকার ছিল। তাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট কম হতো। এখন সংস্কার করলে তা খুবই কষ্টদায়ক হবে। আর সংস্কার না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না।
সুদের হার বাজারব্যবস্থার ওপর ছাড়লেই মূল্যস্ফীতি কমবে, এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদের হার বাজারের ওপর ছাড়লে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে ১১৪-১১৫ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। লুটের মালের মতো যেভাবে পারছে, সেভাবে তারা (ব্যাংক) ডলারের দাম নিচ্ছে।
রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে এনবিআরকেও ডিজিটাল করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আলোচনার জন্য এফবিসিসিআই ও এনবিআরের সমন্বয়ে একটা টাস্কফোর্স আছে। কিন্তু সেটির বৈঠক হয় না। অর্থনীতিকে টেকসই ও শিল্পের উৎপাদন ধরে রাখতে হলে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে জোর দেন তিনি।
‘নব্বই দশকের পর সরকার বদল হয়েছে, নতুন সরকার এসেছে, কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। এই প্রথম সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৭ শতাংশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকে আঁকড়ে ধরেছে। আর আমরা বলেছি, মূল্যস্ফীতি আমদানি হয়েছে; আমাদের সঙ্গে এটির কোনো সম্পর্ক নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সারা বিশ্ব যে ব্যবস্থার দিকে গেল, আমরা সেদিকে গেলাম না।’
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বলেন র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ। ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।