সিরাত বিষয়ক গবেষণার জন্য যে বিষয় জানা প্রয়োজন

প্রকাশকালঃ ০১ জুন ২০২৩ ১২:০৫ অপরাহ্ণ ৬৬ বার পঠিত
সিরাত বিষয়ক গবেষণার জন্য যে বিষয় জানা প্রয়োজন

হান আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে নবুয়তের যে বার্তা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন, তিনি তা প্রথমে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন, অতঃপর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘কোরআনই ছিল নবী (সা.)-এর চরিত্র।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭৪৬)

যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবনে কোরআন ধারণ করেছিলেন, আল্লাহর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছিলেন, তাই দ্বিন ও শরিয়ত বোঝার অন্যতম অবলম্বন সিরাত পাঠ ও গবেষণা।


সিরাতের পরিচয়

সিরাত বলতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয়, সমকালীন অবস্থাগুলো, সাহাবিদের কর্মকাণ্ড সব কিছুকে বোঝায়। কেননা নবীজি (সা.)-এর কাজগুলো যেমন শরিয়তের দলিল, তেমনি সাহাবিদের কাজের প্রতি তাঁর সম্মতিও শরিয়তের দলিল।


সিরাতের পরিধি

সিরাত পাঠ ও গবেষণার পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত। যার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সত্তা ও ব্যক্তিত্ব অন্তর্ভুক্ত। ফলে তাতে আলোচনা হবে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, সেবা ও জীবনের উপভোগ্য বিষয়গুলো; অন্তর্ভুক্ত হবে তাঁর নবুয়ত ও রিসালাত।

ফলে আলোচনা হবে ওহি লাভ, দ্বিন প্রচার, মানুষের প্রতিক্রিয়া, যুদ্ধ ও যুদ্ধাভিযানগুলো; তাতে অন্তর্ভুক্ত হবে দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণগুলো এবং নবী হিসেবে তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো।


স্থান ও সময়ের পরিধি

সিরাতের সময়কাল হলো মহানবী (সা.)-এর মোবারক জন্ম থেকে ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ ৬৩ বছর জীবনের পুরোটাই এখানে আলোচিত হবে। সমগ্র আরব উপদ্বীপ সিরাতের পাদভূমি হিসেবে আলোচিত হবে।

কেননা নবীজি (সা.) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। এখানে নবুয়ত লাভের পর ১৩ বছর দ্বিনের দাওয়াত দেন। এরপর মদিনায় হিজরত করে সেখানে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। প্রতিবেশী বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন, এমনকি মক্কা বিজয় করেন। নবম হিজরি থেকে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রতিনিধিদল আসতে থাকে।

তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর আগেই সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়। হয়তো তারা মুসলমান হয়েছিল অথবা মুসলমানের সঙ্গে যুক্তি হয়েছিল।


সিরাতের প্রকার

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাতকে নানাভাবে ভাগ করা যায়। যেমন সময়কালের বিবেচনায় সিরাত তিন প্রকার। তা হলো :

১. জন্ম থেকে নবুয়ত লাভ : সিরাতের এই অংশে তুলে ধরা হবে মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে আরব জাতি ও আরব উপদ্বীপের অবস্থা কেমন ছিল। সিরাত গবেষকদের জন্য অংশটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের অবস্থাগুলো বুঝবে না, সে ইসলামকে চিনতে পারবে না। এই অধ্যায়ে নবুয়ত লাভের আগে নবীজি (সা.) থেকে যেসব অলৌকিক বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছিল তাও আলোচনা করা হবে।

২. নবুয়ত লাভ থেকে হিজরত পর্যন্ত : এ অংশে হেরাগুহায় নবুয়ত লাভ করার পর থেকে হিজরতের আগ পর্যন্ত মহানবী (সা.) কিভাবে দ্বিনের দাওয়াত দিয়েছিলেন, দ্বিনের জন্য তিনি ও সাহাবিরা কি পরিমাণ কষ্ট ও অত্যাচার সহ্য করেছিলেন তা আলোচনা করা হবে। এই সময়কালকে মক্কি জীবন বা দাওয়াতি জীবন বলা হয়।

৩. মদিনায় হিজরত থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত : এ অংশে মাদানি জীবনের ১১ বছরে তিনি কিভাবে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন, এ সময় দ্বিনের প্রচার ও পরিচালিত যুদ্ধের মূলনীতি কি ছিল এবং ইসলামের বিধি-বিধান কিভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।


বিষয়বস্তুর বিচারে সিরাত

আলোচ্য বিষয় বিবেচনা করলে সিরাতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। তা হলো,

১. শামায়িল ও আখলাক : এ অংশে মহানবী (সা.)-এর দৈহিক অবয়ব, মানুষ হিসেবে তাঁর আচরণ ও কর্মকাণ্ড, চারিত্রিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হবে। বিশেষত যেসব বৈশিষ্ট্য তাঁকে অন্যসব নবী-রাসুল থেকে পৃথক করে তা তুলে ধরা হবে।

২. দালায়িলুন নুবুহওয়াহ : এ অংশে নবীজি (সা.)-এর মুজিজা বা অলৌকিকত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। তাঁর নবুয়ত ও রিসালাতের ব্যাপারে আল্লাহ যে অকাট্য প্রমাণাদি দিয়েছে তা সবিস্তারে বর্ণনা করা হবে। সিরাতের এ অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর মাধ্যমে মানুষের ঈমান দৃঢ় হয়, অন্তরের সংশয় দূর হয়, নবীজি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, তাঁর প্রতি মন অনুগত হয়।

৩. সিয়ার ওয়াল মাগাজি : সিরাতের এ ভাগে নবী করিম (সা.)-এর নানা ধরনের কর্মকাণ্ড, লেনদেন, চুক্তি, অভিযান, যুদ্ধ, অন্যের কাজের স্বীকৃতি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান, ইসলামী আইনের বাস্তবায়নে কর্মকৌশল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

সিরাত গবেষণার গুরুত্ব

মানবজাতির জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত পাঠ ও তা নিয়ে গবেষণা করার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন। নিম্নে সিরাত গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।

১. উত্তম আদর্শের সন্ধান : রাসুল (সা.)-এর জীবনে আল্লাহ মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ রেখেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুলের জীবনে আছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)

২. উত্তম চরিত্রের সন্ধান : রাসুলে আকরাম (সা.) ছিলেন সর্বোচ্চ নীতি-নৈতিকতার অধিকারী। সিরাত গবেষণার মাধ্যমে ব্যক্তি যার সন্ধান পেতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কালাম, আয়াত : ৪)

৩. দ্বিনি অনুপ্রেরণা লাভ : নবী-রাসুল (আ.)-এর জীবন ও ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে ব্যক্তি দ্বিনি অনুপ্রেরণা লাভ করে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘রাসুলদের এসব বৃত্তান্ত আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি, যার মাধ্যমে আমি তোমার অন্তরকে দৃঢ় করি, এর মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য এসেছে উপদেশ ও সাবধান বাণী।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১২০)

৪. কোরআনের অনুশীলনের পদ্ধতি জানা : রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন কোরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তিনি তাঁর জীবনে কোরআন বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষকে কোরআন শিখিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র ছিল কোরআন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৫৮১৩)

৫. কোরআনের ব্যাখ্যা জানা : রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআনের বিধানগুলো ব্যাখ্যা করেছেন, সাহাবিদের তা শিখিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৪৪)

সিরাত গবেষণার পদ্ধতি

সিরাত বিষয়ে উচ্চতর পাঠ ও গবেষণা নিম্নোক্ত পদ্ধতি হতে পারে।

১. অনুসন্ধান : সিরাত গবেষণার জন্য সিরাতের মৌলিক ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থগুলো পাঠ করা অপরিহার্য। পাশাপাশি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের গভীর অধ্যয়ন প্রয়োজন। কেননা কোরআন, হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলোর সমন্বিত পাঠের মাধ্যমেই কেবল একজন গবেষক সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।

২. পাঠ গ্রহণ : মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্মের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে হলে ব্যক্তিগত পাঠই যথেষ্ট নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক পাঠগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গবেষক আলেমদের সহায়তা ছাড়া সিরাতের সব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর নাতি জয়নুদ্দিন আলী বিন হুসাইন (রা.) বলেন, ‘আমরা যেভাবে কোরআনের সুরা পাঠ করতাম, সেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে পাঠ করতাম।

৩. সান্নিধ্য গ্রহণ : অনুসন্ধান ও পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি সিরাতের পাঠককে সিরাত বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষকের সান্নিধ্য লাভ করাও জরুরি। যেন তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং গবেষণার ব্যাপারে সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। যেমন লোকেরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় নবীজি (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে জানতে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কাছে একত্র হতো।

তথ্যঋণ 

১.  প্রবন্ধ : ড. আবদুর রহমান বিন আলী আল-হাত্তাব, মুকাদ্দামাতুন লি-দিরাসাতি আল-সিরাহ আল-নাবাবিয়্যাহ।

২.  প্রবন্ধ : মোস্তফা আ-বদরি, মানহাজুন ইলমিইয়ুন মুকতারাহুন লি-দিরাসাতি আস-সিরাহ।

৩.  প্রবন্ধ : আল-মাসাদিরুল আসলিয়্যাহ লিস-সিরাতিন-নাবাবিয়্যাহ।