মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ১০ বছরের মধ্যেই মুসলিম বাহিনী মিসর, নিকটপ্রাচ্য ও পারস্যের বৃহৎ অঞ্চল জয় করে। তারা এসব অঞ্চলে কাচশিল্পের সঙ্গে পরিচিত হয়। পারস্য, শাম ও মিসরে তখন বিপুল পরিমাণ কাচের তৈজসপত্র তৈরি হতো। মুসলিম কারিগররা তাদের থেকে কাচশিল্পের কৌশল রপ্ত করে এবং তার উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রাখে।
মুসলিম কারিগররা কাচশিল্পে একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। যার ভিত্তি ছিল ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। ফলে মুসলমানের শিল্পকর্মে জ্যামিতিক অলংকরণ, উদ্ভিজ্জ মোটিফ ও ক্যালিগ্রাফির প্রাধান্য দেখা দেয়। যদিও পরবর্তী সময়ে মুসলিম কারিগরদের কাজে মানুষ, পশু, পাখি ও মাছের প্রকৃতি স্থান পেতে থাকে।
কাচশিল্পের বিকাশে মুসলমানদের অবদানঅষ্টম হিজরি শতকে মিসরের মুসলিম কাচশিল্পীরা কাচের ওপর ছবি আঁকা ও ধাতব পদার্থ দিয়ে নকশা করার কৌশল রপ্ত করে। এ সময় তামা ও রুপার স্বচ্ছ রঙিন নকশা, যা কাচের ওপর লাল-বাদামি ও হলুদাভাব তৈরি করত, তা মিসর ও নিকটপ্রাচ্যে তৈরি ইসলামী কাচের জিনিসের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। কাচে তাপ না দিয়ে ঠাণ্ডা রেখে তাতে নকশা করা ছিল মুসলমানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। তারা তা করত একটি ঘূর্ণায়মাণ চাকার ওপর কাচ বসিয়ে ঘষে ঘষে, দাগ কেটে তা মসৃণ করার মাধ্যমে।
এ ক্ষেত্রে তারা হাতে ব্যবহারযোগ্য উপকরণ যন্ত্র ব্যবহার করত। এ ক্ষেত্রে মুসলমান বিশেষ নৈপুণ্য দেখালেও এটা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার। কাচশিল্পে মুসলিম কারিগরদের বিশেষ অবদান হলো ফেসেট-কাটের (ডায়মন্ডের মতো একাধিক কোণবিশিষ্ট) জিনিস তৈরি করা। নবম খ্রিস্টাব্দের শুরুতে তারা জাহাজে রৈখিক অলংকরণে কাচের কারুকাজ করতে শুরু করে। যার মধ্যে ছিল উদ্ভিজ্জ মোটিফ, প্রাণী, পাখি ও জ্যামিতিক অলংকরণ।
নবম ও দশম শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন প্রকার শৈল্পিক কাজে কাচের ব্যবহার ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। মুসলিমরা শিলা স্ফটিকের মতো কাচেই বেশির ভাগ অলংকরণ করত। তাদের অলংকরণ ভেতর ও বাইরে সমান সৌন্দর্য সৃষ্টি করত। একাদশ শতাব্দী থেকে ত্রয়দশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বে কাটিং ও রঙহীন কাচের পরিবর্তে রঙিন কাচের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এ সময় কাচের আসবাব তৈরিতে ছাঁচের ব্যবহার শুরু হয়। সাদা পটভূমির ওপর রেগুনি, নীল ও সবুজ রঙের কাচ দ্বারা নকশা করা হতো। সে সময় ফুল ও পালকের আদলেও আসবাস তৈরি হতো।
পরবর্তী দুই শতাব্দীতে সিরীয় ও মিসরীয় অঞ্চলের কাচশিল্পীরা বিভিন্ন আকৃতি ও আকারের কাচের আসবাব তৈরি শুরু করে। তারা এতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একাধিক রং ও নকশা ব্যবহার করত। যেমন মসজিদের জন্য জাহাজাকৃতির ঝারবাতি, জাহাজাকৃতির পানপাত্র, বর্ণিল শোপিস ইত্যাদি। এসব শিল্পকর্মের জন্য যেমন দরকার ছিল সৃজনশীল চিন্তার, তেমনি দরকার কারিগরি দক্ষতার। কেননা তাপ দিয়ে স্বর্ণচূর্ণ অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে গলিয়ে কাচের ওপর নকশা করতে হতো। কাচের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতেও সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হতো।
মধ্যযুগের শেষ ভাগে ইউরোপীয়ানরা বহিরভাগের নকশা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্য মুসলিম বিশ্বের কাচশিল্পের উচ্চ প্রশংসা করত। কখনো কখনো তারা এটাকে পবিত্র ভূমির স্মৃতিস্মারক মনে করত। মুসলিম বিশ্বের কাচের আসবাবগুলোতে বেশির ভাগ সময় সোনালি প্রলেপ ও মিনাকারি কাজ করা হতো। ইউরোপের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে এমন বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। কাথিড্রালের কোষাগারগুলোতে এমন অসংখ্য আসবাব রয়েছে। মুসলিম বিশ্ব থেকে কাচের তৈরি আসবাব সুদূর চীনেও রপ্তানি করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
চতুর্দশ শতাব্দীর পরে উসমানীয়, মোগল ও সাফাভিদ সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বিশ্বে কাচশিল্প অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। এ সময় কাচশিল্পের বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকে এবং মুসলিম কারিগররাই তার নেতৃত্ব দেয়। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর পর মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হলে এবং ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলে কাচশিল্পের নেতৃত্ব মুসলমানদের হাত থেকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর হাতে চলে যায়। ফলে মুসলিম বিশ্বের পরিবর্তে ইউরোপ হয়ে ওঠে কাচশিল্পের প্রধান কেন্দ্র।