ইবাদত বলতে ইসলামে যা বোঝায়

প্রকাশকালঃ ১১ জুলাই ২০২৩ ০২:০৩ অপরাহ্ণ ২১৭ বার পঠিত
ইবাদত বলতে ইসলামে যা বোঝায়

বাদত বলতে সাধারণত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি মনে করা হয়। তবে ইসলামে ইবাদতের ধারণা আরো বিস্তৃত। প্রত্যেক এমন কাজ যা আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যাতে তিনি খুশি হন, তা ইবাদত। যে কাজ আল্লাহ অপছন্দ করেন এবং যাতে তিনি ক্ষুব্ধ হন তা পরিহার করা ইবাদত।

মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য ইবাদত আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। ইবাদত মানবসৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে যেন তারা আমারই ইবাদত করে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)

ইবাদতের সঙ্গে পরকালীন বিশ্বাসের সম্পর্ক
ইবাদতের সঙ্গে পরকালের বিশ্বাসের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। মূলত মানুষ পরকালীন পুরস্কারের আশা ও শাস্তির ভয়ে ইবাদত করে থাকে। এ জন্য যারা ইবাদতবিমুখ তাদের সতর্ক করে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে আমি তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১১৫)

ইসলামে ইবাদতের ধারণা
আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর জন্য বিনয় ও তাঁর কাছে আত্মসমর্পণই ইবাদতের মূলকথা। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যেকোনো বৈধ কাজ নবীজি (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী করলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে। সুতরাং আল্লাহর জন্য নিবেদিত ভালোবাসা, ভয়, আশা, নিষ্ঠা, কৃতজ্ঞতা, ধৈর্য, সন্তুষ্টি, আকর্ষণ ইবাদত; আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, অশ্রুবিসর্জন, আত্মবিসর্জন ইবাদত; হালাল খাবার খাওয়া, হারাম পরিহার করা, মা-বাবার আনুগত্য করা, উত্তম আচরণ, বড়কে সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, অসহায়কে দয়া করা, মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, অঙ্গীকার পূরণ করা, আমানত রক্ষা করা, প্রতারণা না করা, দৃষ্টি সংযত রাখা, লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করা, সৎ কাজের আদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, দ্বিনের দাওয়াত দেওয়া, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা ইবাদত।


ইবাদতের বিস্তৃত পরিধি
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে ইবাদতের ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত মুমিনের পুরো জীবনটাই ইবাদত হিসেবে গণ্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বোলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগত্গুলোর প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমি তাঁরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩)

সময়ের বিবেচনায়ও ইবাদত জীবনময় বিস্তৃত।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কোরো এবং তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও; তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কোরো।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ৯৮-৯৯)

পাপ পরিহারও ইবাদত
পাপ পরিহার করা ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাঁর আনুগত্যের পাশাপাশি পাপকাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৬)

অন্য আয়াতে পাপ পরিহার করাকে দ্বিনের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দিতে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৩৬)

ইবাদতের ইসলামী রীতি
আল্লাহ প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীকে ইবাদতের পৃথক রীতি-নীতি দান করেছেন। পৃথক এই রীতি-নীতিকে বলা হয় শরিয়ত। আল্লাহ একেক নবীকে একেক শরিয়ত দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। মুসলিম জাতিরও রয়েছে পৃথক শরিয়ত ও ইবাদতের নির্দিষ্ট পদ্ধতি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছি ‘ইবাদতপদ্ধতি’, যা তারা অনুসরণ করে। সুতরাং তারা যেন তোমার সঙ্গে বিতর্ক না করে এ ব্যাপারে। তুমি তাদের তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কোরো, তুমি সরল পথেই প্রতিষ্ঠিত।” (সুরা হজ, আয়াত : ৬৭)

সব ইবাদতের মর্যাদা সমান নয়
ইসলাম নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতকে যেমন ইবাদত বলেছে, তেমন রাস্তা থেকে কষ্টকর বস্তু সরিয়ে দেওয়াকেও ইবাদত বলেছে। তবে উভয় ইবাদতের মর্যাদা সমান নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর পছন্দনীয় সব কথা ও কাজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তবে ইবাদতের মধ্যে কিছু আছে মৌলিক ও কিছু আনুষঙ্গিক। যেসব ইবাদতের নির্দেশ সরাসরি কোরআন ও হাদিসে আছে তা মৌলিক। যেমন: নামাজ, রোজা ইত্যাদি। আর কোনো বৈধ কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা ইবাদত। এগুলো মৌলিক নয়, আনুষঙ্গিক।’ (প্রবন্ধ : শুমুলিয়্যাতু মাফহুমিল ইবাদাতি ফিল ইসলাম)

ইবাদত কবুলের শর্ত
উলামায়ে কেরাম কিছু বিষয়কে ইবাদত কবুলের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা হলো—

১.  কাজটি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হতে হবে। অবৈধ কোনো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পূতঃপবিত্র, তিনি কেবল পবিত্র বিষয়গুলোই গ্রহণ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০১৫)

২.  নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ কাজের উদ্দেশ্য সৎ হওয়া। নিয়তের কারণে বৈধ বিষয়ও অবৈধ হয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিয়তের ওপর কাজের প্রতিদান নির্ভর করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)

৩.  ইহসানের সঙ্গে আমল করা। কেননা হাদিসের ভাষ্য হলো, ‘আল্লাহ সব কিছুর ওপর ইহসান আবশ্যক করেছেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৪১১)

৪.  আল্লাহর সীমালঙ্ঘন না করা। ইবাদতের ক্ষেত্রেও শরিয়তের সীমালঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ। যেমন ইসলাম দুনিয়াবিমুখ হতে বলে, তবে বৈরাগ্য ইসলামে নিষিদ্ধ।

৫.  সুন্নতের অনুসরণ। বিদআত পরিহার করা। ইবাদত কবুলের জন্য তা সুন্নত বা নবীজি (সা.)-এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বোলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কোরো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)

ইবাদতে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি
ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। মুমিন পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেবে, তবে জীবন-জীবিকা বিপন্ন করে নয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান কোরো।’ (সুরা জুমা, আয়াত : ১০)

আল্লাহ সবাইকে যথাযথভাবে ইবাদত করার তাওফিক দিন। আমিন