যে গণিতবিদ দাসী থেকে রাজ উপদেষ্টা হন

প্রকাশকালঃ ২৯ আগu ২০২৩ ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ ১৬৫ বার পঠিত
যে গণিতবিদ দাসী থেকে রাজ উপদেষ্টা হন

লুবনা কুরতুবিয়্যা ছিলেন একজন স্প্যানিশ মুসলিম নারী গণিতবিদ ও কবি। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা ও বিজ্ঞানে বিশেষ দক্ষতার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। লুবনার জন্ম হয়েছিল একজন দাসী হিসেবে এবং তিনি স্পেনের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ ‘মাদিনাত আল জাহরা’তে বেড়ে ওঠেন। তিনি স্পেনের উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় হাকামের পাঠাগারের একজন লিপিকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

পরবর্তী সময়ে নিজের মেধা, প্রতিভা, জ্ঞানগত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার দরুন রাজ-উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। লুবনা খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমানের আমলে মাদিনাত আল জাহরা প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল একজন দাসী হিসেবে। কিন্তু জন্মের পরপরই আরো অনেকের মতো তিনি মুক্তি পান।

তবে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এইচ এম পুয়েত্রা ভিলচেজের দাবি লুবনা ছিলেন খলিফা আবদুর রহমানের কন্যা। একজন মুক্তিপ্রাপ্ত দাসীর গর্ভে তাঁর জন্ম হয়। রাজকীয় হেরেমেই তিনি বেড়ে ওঠেন। রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় লুবনার শিক্ষাদীক্ষা সম্পন্ন হয়, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে একজন গণিতবিদ, ভাষাবিদ, কবি ও রাজ উপদেষ্টা হতে সাহায্য করেছিল।


অবশ্য শুধু লুবনা নয়, বরং ইসলামী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুগে যুগে মুসলিম শাসকরা বহুসংখ্যক দাস মুক্ত করেছেন, তাদের শিক্ষিত করে উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করেছেন। লুবনার কর্মজীবন শুরু হয় দ্বিতীয় আল হাকামের পাঠাগারের একজন লিপিকার হিসেবে। খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের সময় ১৭০ জন এমন নারী সম্পর্কে জানা যায়, যাঁরা শহর ও শহরতলিতে মূল্যবান পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করতেন। 

পরবর্তী সময়ে খলিফা তাঁকে একজন আবাসিক সহকারী ও পণ্ডিত হিসেবে নিয়োগ দেন। কূটনৈতিক বার্তা প্রেরণ এবং রাজকীয় ফরমান লেখার ক্ষেত্রে খলিফা লুবনার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। আরবি, স্প্যানিশের পাশাপাশি তিনি গ্রিক, হিব্রু ও লাতিন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

লুবনার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল রাজকীয় পাঠাগারের তত্ত্বাবধান করা। আর লিপিকার হিসেবে কাজটি তাঁর জন্য সহজ ছিল। পাঠাগারের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠের সুযোগ পান এবং সেগুলোতে মন্তব্য ও টীকা লেখেন। যার মধ্যে আর্কিমিডিস ও ইউক্লিডও ছিল। হাদসাই বিন শাপরুতের সঙ্গে তিনি মাদিনাত আল জাহরার রাজকীয় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা এবং এর সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই পাঠাগারে কমপক্ষে চার লাখ বই ছিল। পাঠাগারের জন্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। এ সময় তিনি কায়রো, দামেস্ক, বাগদাদসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করেন।


রাজপরিবারের শিশুদের জন্য লুবনাকে আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাসাদের বাইরেও তিনি শিশুদের গণিত শিক্ষা দিতেন। প্রায়ই শিশুরা তাঁর সঙ্গে প্রাসাদে চলে আসত লুবনার কবিতা শুনতে। তিনি কর্ডোভার পথশিশুদের জন্য একটি বিশেষ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি তাদের ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণিত ও দর্শনশাস্ত্রের পাঠদান করতেন।

আল্লামা ইবনে বাশকুয়াল (রহ.) তাঁর ‘আল সিলাহ ফি তারিখি আইম্মাতিল আন্দুলুস’ গ্রন্থে লুবনা কুরতুবিয়্যা সম্পর্কে লেখেন, ‘তিনি ছিলেন একজন মেধাবী লেখিকা, ব্যাকরণবিদ, কবি ও পাটিগণিতে পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানের অন্বেষা, পাণ্ডিত্য ও সততায় প্রাসাদে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। গণিতসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন। বিজ্ঞানে পারদর্শিতা এবং বীজগণিত ও জ্যামিতিক সমস্যার সমাধানে তাঁর উচ্চতর দক্ষতা তাঁকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দিয়েছিল।’

এ ছাড়া লিপিকার ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী হিসেবেও তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন। লুবনা কুরতুবিয়্যার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। ধারণা করা হয়, তিনি ৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ২০১৯ সালে তাঁর নামে স্পেনের কর্ডোভা শহরের একটি সড়কের নাম রাখা হয় ‘অ্যাভেনিদা ইস্ক্রাইবা লুবনা’।