সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় দুর্নীতির ছায়া: ‘মিতা’ জুটির অবসান, কিন্তু রয়ে গেলো মূল কারিগর

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ০৭ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫২ অপরাহ্ণ   |   ১২০ বার পঠিত
সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় দুর্নীতির ছায়া: ‘মিতা’ জুটির অবসান, কিন্তু রয়ে গেলো মূল কারিগর

গাইবান্ধা প্রতিনিধি:-



গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির এক ভয়াবহ চক্র সক্রিয় ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন (মিঠু)। স্থানীয়ভাবে ‘মিতা’ জুটি নামে পরিচিত এই দুজনের বিরুদ্ধে পৌর তহবিল লুটপাট, ভাউচার জালিয়াতি, ঠিকাদারদের জামানতের অর্থ আত্মসাৎ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ নয়ছয়ের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই উঠে আসছিল।

 

২০২১ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে আব্দুল্লাহ আল মামুন পরাজিত হলে ‘মিতা’ জুটির আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। কিন্তু দুর্নীতির মূল কারিগর, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন (মিঠু), এখনো বহাল তবিয়াতে রয়েছেন। সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী দীর্ঘদিন একই স্থানে দায়িত্ব পালন করা নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি একাধিকবার বদলি নিয়েও শেষ পর্যন্ত সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় ফিরে আসতে সক্ষম হন।
 

স্থানীয়দের অভিযোগ, মিঠু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে আসছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে নতুন উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল হক সরকারকেও তিনি নিজের দুর্নীতির চক্রে যুক্ত করেছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে।
 

এদিকে, পৌরসভার স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। স্থানীয়দের দাবি, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, যাতে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
 

অনুসন্ধানে উঠে আসা গাইবান্ধার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার আবদুল লতিফ হক্কানীর নিজ নামিও প্রতিষ্ঠানের জামানতের ১১ লাখ ২১ হাজার ৮২৯ টাকা তৎকালীন মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুন ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন (মিঠু) মিলে আত্মসাতের করে।
 

এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আবদুল লতিফ হক্কানী জানান, ২০২০ সালে কাজ সমাপ্তির পর জামানতের টাকা ফেরতের জন্য আবেদন করা হলেও পৌর কর্তৃপক্ষ তা ফেরত দেয়নি। পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালকের নির্দেশের পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তিন যুগের বেশি সময় ঠিকাদারি করেছি, কিন্তু এমন দুর্নীতি আগে কখনো দেখিনি। আমার জামানতের টাকা ফেরত দেওয়া হোক এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
 

সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন (মিঠু) এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তার এক সহযোগী, উপ-সহকারী শহিদুল হক সরকার, জানান যে, তিনি নতুন যোগদান করেছেন এবং কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। তবে, তিনি অতীতের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
 

সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
 

এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুর রশীদ রেজা সরকার বলেন, আমি বর্তমানে মেয়র নেই তবে বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত আছি এবং আমি মেয়র থাকাকালীন এই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় তদন্তের জন্য লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম।
 

এদিকে আরো অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুন ও তার সহযোগীরা এডিপি, ল্যাব এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগি করে তারা প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
 

এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয়রা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
 

অন্যদিকে অনুসন্ধানে উঠে আসা তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক টি আই এম মকবুল হোসেন প্রামাণিক দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেওয়া এক অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, সাবেক পৌরসভার মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুন ও উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন (মিঠু) ভুয়া ভাউচার তৈরি করে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া, হাট-বাজারের ইজারা ও পৌরকরের অর্থও এই মিতা জুটি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
 

শুধু তাই না দুর্নীতির বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গেলে মেয়র সাংবাদিকদের হুমকি দেন, গালিগালাজ করেন এবং মানহানির মামলার ভয় দেখান। বিশেষ করে, সাংবাদিক খালেদ হোসেন মেয়রের অনুসারীদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন, যা নিয়ে সে সময় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিলো।


এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার বাসিন্দারা ইতিপূর্বে একাধিকবার পৌরসভার এই মিতা জুটির দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তারা জোরালো তদন্তের দাবি জানিয়ে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কারণে তাদের দুর্নীতির বিচার হয়নি।
 

এ বিষয়ে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জের পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নাজির হোসেন বলেন, আমরা সব সময় স্বচ্ছতা ও সুশাসনের পক্ষে কাজ করি। দুর্নীতি বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে এবং প্রয়োজনীয় তদন্ত করা হবে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করব এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিলেও, স্থানীয় সরকার প্রশাসন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে স্থানীয়দের। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে বহাল তবিয়তে থাকবেন, নাকি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এটি এখন সময়ের বড় প্রশ্ন বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন পৌরবাসী।